ইফতেখার হোসাইন :
মেধাবী শব্দটির বহুমাত্রিকত ব্যবহার আজকাল ঢের বেড়েছে যার দরুণ এর কদরও কিছুটা কমেছে। বলা হয়ে থাকে, দামি কথা পাঁচ মুখে ফিরে কিছুটা গুরুত্ব হারায়। কিন্তু ফওজিয়ার ক্ষেত্রে মেধাবী এ শব্দটির প্রায়োগিক দিক সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ফওজিয়া ছিলেন একজন জাত মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষায় ফার্মেসি বিভাগে জিপিএ চারের মধ্যে ৩.৯৬ পেয়ে প্রথম হয়েছেন। যা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ফার্মেসি বিভাগের ইতিহাসে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমন ঈর্ষনীয় সাফল্য রয়েছে তার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও। উভয় পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এরকম মেধাবী ও উচ্চ রেজাল্টধারীরাই পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। আর কিছুদিন পরে তিনিই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন। মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগে ফওজিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিকট হতে সেরা শিক্ষার্থীর ক্রেস্ট উপহার নিয়েছিলেন। একই বিভাগের প্রভাষক মনির হোসেনের সঙ্গে বাগদানও সম্পন্ন ছিলো ফওজিয়ার। আসছে জানুয়ারীতেই এ দম্পতির বিয়ে অনুষ্ঠানের কথা। সুযোগ ছিলো তিনটি পরিবারের একটি সূত্রে আবদ্ধ হবার। কিন্তু একটিমাত্র অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা তাদের সব কেড়ে নিলো। ভেঙ্গে দিলো সমস্ত স্বপ্ন আর স্বাদ। হরণ করলো তিনটি পরিবারে সুখ আর আনন্দের সম্মীলন। বিয়ের পিঁডিতে বসা হলো না ফওজিয়ার। মেহেদি রঙে হাত সাজানোর আগেই রক্তে রঞ্জিত হলো ফওজিয়ার শরীর।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ফওজিয়ার বাডি বিশ্বব্যিালয়ের অদূরে পশ্চিম শাহপুর গ্রামে। বাবা স্থানীয় কন্ট্রাক্টর, মা ঘরকন্যা করেন। তিন ভাইয়ের মাজে একমাত্র বোন ফওজিয়া যেমন ছিলেন মেধাবী, সুশ্রী তেমনি বুদ্ধিমতি। তার জন্মের পর বাবা আদর করে নাম রেখেছেন সিলভি। আর মা রাখলেন ফওজিয়া। পুরো নাম ফওজিয়া মোসলেম সিলভি (২১)। সে ছিলো পরিবার-আত্মীস্বজন সবার পরম আদরের। সিলভিকে তার বাবা দুচোখ বন্ধ করে স্নেহে বুকে নিয়ে বলতো, মা’ তোমাকে আমি বুকের মধ্যমণি করে ধরে রাখতে চাই। এই বলে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাখতো বাবা। কিন্তু আসলেই কি বাবা তার আদরে আহ্লাদ, কলিজার টান সিলভিকে ধরে রাখতে পেরেছেন। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা কি তার মেয়েকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্নের স্বাদ পূরণ করতে পেরেছেন, পারেননি। কিংবা মেয়ে কি পেরেছে তার সহজ-সরল বাবার হৃদয়ে মাথা গুঁজে থাকতে। পেরেছে কি তার স্বপ্নের সমান বড় হয়ে উঠতে, পারে নি। কারণ আমাদের চারপাশেই রয়েছে আকস্মাৎ জীবন কেড়ে নেয়ার যাবতীয় আয়োজন। ফলে ফওজিয়াদের মতো মেয়েদের স্বপ্নপূরণের আগেই অনিচ্ছাকৃত পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়।
গত ১৯ নভেম্বর রোববার দুপুরে প্রতিদিনের মতো ফওজিয়া ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ধরতে। কিন্তু
সে ক্লাস আর তার ধরা হলো না। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ফওজিয়ার ও তার সমস্ত স্বপ্নের। অধরা থেকে গেলো তার নিজের ও পবিারের স্বপ্ন। হবুবর মনির হোসেনের ভালোবাসারও নিদারুণ মৃত্যু ঘটেছিল সেদিন। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, প্রিয় সহপাঠী কারো ভালোবাসাই সেদিন তাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরাতে পারেনি।
প্রতিদিনের মতোই ফজরের নামায, রুটিন স্ট্যাডি শেষে যোহরের নামাজ পড়ে ফওজিয়া। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলো সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত বাস মিস করায় অগত্যা উঠে পড়েছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায়, আর সেটাই যে তার জন্য কাল হবে তা কি জানতো ফওজিয়া। অটোতে প্রথমে বসেছিলো বাম পাশে, কিন্তু ডানপাশে বসা ফক্সের রোগী অন্য এক মেয়ের রোদে বসতে কষ্ট হচ্ছিল বিধায় সিলভি সিট ইন্টার চেঞ্জ করে ডান পাশে এসে বসে। এখানেই মেলে ফওজিয়ার ব্যক্তিগত মানবিকতার পরিচয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস কিছুদুর চলার পর অটোরিক্সাটি যখন ঠক্কর নামক জায়গায় এসে হার্ডব্রেক করে, ফওজিয়া রাস্তার মাঝখানে ছিটকে পড়ে। আর বিপরীতি দিক থেকে আসা পিকআপ ভ্যান তাকে চাপা দেয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফওজিয়া।
তার এমন মৃত্যুতে গোটা ক্যাম্পাসে ও নোয়াখালীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ও নিহতের পরিবারকে সমবেদনা জানান। পরে এলাকাবাসির সঙ্গে জানাজায় অংশ নেন। উপাচার্য রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফওজিয়ার পরিবারকে তিন লাখ টাকার আর্থিক সহায়তার ব্যাবস্থা করেন। এছাড়া স্থানীয় সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরি ফওজিয়ার পরিবারের জন্য একটি ঘর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। পরেরদিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা ও ঘাতক ভ্যানচালকের গ্রেপ্তারে’র দাবিতে ক্যাম্পাসে ও সোনাপুর জিরোপয়েন্টে মানববন্ধন করা হয়। মানবন্ধনে বক্তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্থানীয় সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরি সহ প্রশাসনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দের যাতায়তের সড়কটির প্রকল্পের কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়াও মানববন্ধনে-সোনাপুর-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা প্রসস্তকরণ, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসন করা, অটোরিক্সায় পাঁচের অধিক যাত্রী নিষিদ্ধকরণ, জেড় মোড়ের রাস্তা সোজাকরণ এবং রয়্যাল হসপিটালের মান-সম্মত সেবা নিশ্চিতকরণ সহ নানামুখি দাবি উত্থাপন করা হয়।
প্রসঙ্গত ২০১৩ সালে অটোরিক্সা দুর্ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবরিনা জাহনা নিহত হন। ২০১৬ সালে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড প্রসেসিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রী রহিমা খাতুনও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। আজ পর্যন্ত এসব ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। তাই দুর্ঘটনা যেন থামছেই না। কিন্তু একটি মৃত্যু যে নিহতের গোটা পরিবারকে সর্বশান্ত করে দিতে পারে তা কেবল ভুক্তভোগীই পরিবারগুলোই জানে। আমাদের শিক্ষার্থী ফওজিয়ার জীবনে অনেক বড় ও কাঙ্খিত একটি পরিশিলীত স্বপ্ন ছিলো তা হচ্ছে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার। তার বাবারও শখ ফওজিয়া মানুষের মত মানুষ হয়ে জাতিগঠনে শিক্ষকতার মতো পেশায় ব্রতী হবে। যদিও মেয়েকে পড়ানোর শিক্ষাব্যয় বহনে বাবার পর্যাপ্ত সামর্থ্য খুব একটা ছিলো না। মেয়েও এসব বুঝতে পারতো। তাই নিজের খরচেই এতদিন পড়াশোনা চালিয়েছিলো। দুই-একটা টিউশনি করতো সে। আর তাই দিয়ে নিজের পাঠব্যয় চালিয়ে নিতো। এমন পরিশ্রমি মেয়ের মৃত্যু সংবাদ যখন তার বাবা-মা পেলেন, তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল? পৃথিবীর আর দ্বিতীয় কোনো বাবা-মা সেটা কোনোদিন বুঝতে পারবে না।
ফওজিয়ার এমন করুণ মৃত্যুকে তার বাবার মনের ভেতর দিয়ে কী ঝড বয়ে গেছে তখন, মায়ের বুকের ভেতর দিয়ে তখন কেমন দুঃখ বন্যা বয়েছিল? এ হতভাগ্য দম্পতির সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে এখন কী অসহ্য অমেয় বেদনার পাহাড চেপে বসে আছে! আমরা তা কল্পনাও করতে পারছি না। ফওজিয়ার ছোট ভাইদের অঝোর কান্নার এই চাপ কি আমার নিতে পারছি। তাদের কী প্রাণবন্ত একটা বোন ছিল। যে নোবিপ্রবি’র সেরা একটি সাবজেক্টে পড়তো। কি অবলীলায় বন্ধুদের সঙ্গে মিশতো, গল্প আড্ডা আর খুনসুটিতে কাটতো ফওজিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। শিক্ষকদের দেয়া লেকচার অ্যাসাইনমেন্ট ও সময়ে সময়ে দেয়া দিকনির্দেশনা মেনে ক্যারিয়ার সাজানোয় ব্যস্ত ছিলো সে। তার করা হ্যান্ড নোট এখনো নোবিপ্রবি ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় পাস করার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু আমাদের সে ফওজিয়া আজ আকাশের পানে তাকিয়ে শুয়ে আছে মাটির কবরে। আর চাঁদের আলোতে কবরের ঘাসে ঝিকমিক করছে তার প্রাণোচ্ছ্বল অবিরাম সেই হাসি। এসব নিয়ে ফওজিয়ার বন্ধুরা ফেসবুকে এখন শোকগাঁথা লিখছে। কিন্তু ফওজিয়া আর কোনোদিন ফেসবুকে বন্ধুদের লেখার উত্তর দিবে না। নিজের ওয়ালে লিখবে না, সে কেমন আছে। কেমন থাকতে চায়। এমন সব স্মৃতি আর নস্টালজিয়ায় যেন আর পুড়তে না হয় তাই ভেবে ফওজিয়ার বাগদত্তা মনির হোসেনও নোবিপ্রবি’র চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর দ্রোহের অঙ্গীকার নিয়ে ফওজিয়ার ঘাতকদের গ্রেপ্তার চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ভয়ানক দুর্ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সব দল আর মতের লোকেরা আজ উচ্চকণ্ঠ ও একাত্ম। অচিরেই এ নির্মম ঘটনার বিচার সবাই দেখতে চায় সকলে। কোনোভাবেই অন্যান্য ঘটনার মতো বিলম্বিত যেন না হয় এর বিচার কাজ। ফওজিয়ার মৃত্যুতে দোষীদের গ্রেপ্তারের আর প্রতিবাদের মিছিল আরো বড় হোক। এ প্রতিবাদ থেকে প্রগতি ছড়িয়ে পড়ুক। প্রতিবাদের আগুন আমাদের চেতনায় মশাল হয়ে জ্বলুক। আর রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে যেন বিন্দুমাত্র গড়িমসি না করে। ড্রাইভার থেকে শুরু করে প্রত্যেক পেশাদার ব্যক্তিও যেন নিজেকে শুদ্ধ করতে ব্রতী হয়। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র যেন সড়কে যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধানে তৎপর হয়। প্রতিটি সড়ক হয় যেন শান্তির, সড়ক যেন মৃত্যুর মিছিলে পরিণত না হয়।
মেধাবী শব্দটির বহুমাত্রিকত ব্যবহার আজকাল ঢের বেড়েছে যার দরুণ এর কদরও কিছুটা কমেছে। বলা হয়ে থাকে, দামি কথা পাঁচ মুখে ফিরে কিছুটা গুরুত্ব হারায়। কিন্তু ফওজিয়ার ক্ষেত্রে মেধাবী এ শব্দটির প্রায়োগিক দিক সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ফওজিয়া ছিলেন একজন জাত মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষায় ফার্মেসি বিভাগে জিপিএ চারের মধ্যে ৩.৯৬ পেয়ে প্রথম হয়েছেন। যা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ফার্মেসি বিভাগের ইতিহাসে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমন ঈর্ষনীয় সাফল্য রয়েছে তার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও। উভয় পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এরকম মেধাবী ও উচ্চ রেজাল্টধারীরাই পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। আর কিছুদিন পরে তিনিই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন। মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগে ফওজিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিকট হতে সেরা শিক্ষার্থীর ক্রেস্ট উপহার নিয়েছিলেন। একই বিভাগের প্রভাষক মনির হোসেনের সঙ্গে বাগদানও সম্পন্ন ছিলো ফওজিয়ার। আসছে জানুয়ারীতেই এ দম্পতির বিয়ে অনুষ্ঠানের কথা। সুযোগ ছিলো তিনটি পরিবারের একটি সূত্রে আবদ্ধ হবার। কিন্তু একটিমাত্র অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা তাদের সব কেড়ে নিলো। ভেঙ্গে দিলো সমস্ত স্বপ্ন আর স্বাদ। হরণ করলো তিনটি পরিবারে সুখ আর আনন্দের সম্মীলন। বিয়ের পিঁডিতে বসা হলো না ফওজিয়ার। মেহেদি রঙে হাত সাজানোর আগেই রক্তে রঞ্জিত হলো ফওজিয়ার শরীর।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ফওজিয়ার বাডি বিশ্বব্যিালয়ের অদূরে পশ্চিম শাহপুর গ্রামে। বাবা স্থানীয় কন্ট্রাক্টর, মা ঘরকন্যা করেন। তিন ভাইয়ের মাজে একমাত্র বোন ফওজিয়া যেমন ছিলেন মেধাবী, সুশ্রী তেমনি বুদ্ধিমতি। তার জন্মের পর বাবা আদর করে নাম রেখেছেন সিলভি। আর মা রাখলেন ফওজিয়া। পুরো নাম ফওজিয়া মোসলেম সিলভি (২১)। সে ছিলো পরিবার-আত্মীস্বজন সবার পরম আদরের। সিলভিকে তার বাবা দুচোখ বন্ধ করে স্নেহে বুকে নিয়ে বলতো, মা’ তোমাকে আমি বুকের মধ্যমণি করে ধরে রাখতে চাই। এই বলে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাখতো বাবা। কিন্তু আসলেই কি বাবা তার আদরে আহ্লাদ, কলিজার টান সিলভিকে ধরে রাখতে পেরেছেন। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা কি তার মেয়েকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্নের স্বাদ পূরণ করতে পেরেছেন, পারেননি। কিংবা মেয়ে কি পেরেছে তার সহজ-সরল বাবার হৃদয়ে মাথা গুঁজে থাকতে। পেরেছে কি তার স্বপ্নের সমান বড় হয়ে উঠতে, পারে নি। কারণ আমাদের চারপাশেই রয়েছে আকস্মাৎ জীবন কেড়ে নেয়ার যাবতীয় আয়োজন। ফলে ফওজিয়াদের মতো মেয়েদের স্বপ্নপূরণের আগেই অনিচ্ছাকৃত পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়।
গত ১৯ নভেম্বর রোববার দুপুরে প্রতিদিনের মতো ফওজিয়া ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ধরতে। কিন্তু
সে ক্লাস আর তার ধরা হলো না। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ফওজিয়ার ও তার সমস্ত স্বপ্নের। অধরা থেকে গেলো তার নিজের ও পবিারের স্বপ্ন। হবুবর মনির হোসেনের ভালোবাসারও নিদারুণ মৃত্যু ঘটেছিল সেদিন। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, প্রিয় সহপাঠী কারো ভালোবাসাই সেদিন তাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরাতে পারেনি।
প্রতিদিনের মতোই ফজরের নামায, রুটিন স্ট্যাডি শেষে যোহরের নামাজ পড়ে ফওজিয়া। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলো সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত বাস মিস করায় অগত্যা উঠে পড়েছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায়, আর সেটাই যে তার জন্য কাল হবে তা কি জানতো ফওজিয়া। অটোতে প্রথমে বসেছিলো বাম পাশে, কিন্তু ডানপাশে বসা ফক্সের রোগী অন্য এক মেয়ের রোদে বসতে কষ্ট হচ্ছিল বিধায় সিলভি সিট ইন্টার চেঞ্জ করে ডান পাশে এসে বসে। এখানেই মেলে ফওজিয়ার ব্যক্তিগত মানবিকতার পরিচয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস কিছুদুর চলার পর অটোরিক্সাটি যখন ঠক্কর নামক জায়গায় এসে হার্ডব্রেক করে, ফওজিয়া রাস্তার মাঝখানে ছিটকে পড়ে। আর বিপরীতি দিক থেকে আসা পিকআপ ভ্যান তাকে চাপা দেয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফওজিয়া।
তার এমন মৃত্যুতে গোটা ক্যাম্পাসে ও নোয়াখালীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ও নিহতের পরিবারকে সমবেদনা জানান। পরে এলাকাবাসির সঙ্গে জানাজায় অংশ নেন। উপাচার্য রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফওজিয়ার পরিবারকে তিন লাখ টাকার আর্থিক সহায়তার ব্যাবস্থা করেন। এছাড়া স্থানীয় সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরি ফওজিয়ার পরিবারের জন্য একটি ঘর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। পরেরদিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা ও ঘাতক ভ্যানচালকের গ্রেপ্তারে’র দাবিতে ক্যাম্পাসে ও সোনাপুর জিরোপয়েন্টে মানববন্ধন করা হয়। মানবন্ধনে বক্তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্থানীয় সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরি সহ প্রশাসনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দের যাতায়তের সড়কটির প্রকল্পের কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়াও মানববন্ধনে-সোনাপুর-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা প্রসস্তকরণ, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসন করা, অটোরিক্সায় পাঁচের অধিক যাত্রী নিষিদ্ধকরণ, জেড় মোড়ের রাস্তা সোজাকরণ এবং রয়্যাল হসপিটালের মান-সম্মত সেবা নিশ্চিতকরণ সহ নানামুখি দাবি উত্থাপন করা হয়।
প্রসঙ্গত ২০১৩ সালে অটোরিক্সা দুর্ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবরিনা জাহনা নিহত হন। ২০১৬ সালে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড প্রসেসিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রী রহিমা খাতুনও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। আজ পর্যন্ত এসব ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। তাই দুর্ঘটনা যেন থামছেই না। কিন্তু একটি মৃত্যু যে নিহতের গোটা পরিবারকে সর্বশান্ত করে দিতে পারে তা কেবল ভুক্তভোগীই পরিবারগুলোই জানে। আমাদের শিক্ষার্থী ফওজিয়ার জীবনে অনেক বড় ও কাঙ্খিত একটি পরিশিলীত স্বপ্ন ছিলো তা হচ্ছে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার। তার বাবারও শখ ফওজিয়া মানুষের মত মানুষ হয়ে জাতিগঠনে শিক্ষকতার মতো পেশায় ব্রতী হবে। যদিও মেয়েকে পড়ানোর শিক্ষাব্যয় বহনে বাবার পর্যাপ্ত সামর্থ্য খুব একটা ছিলো না। মেয়েও এসব বুঝতে পারতো। তাই নিজের খরচেই এতদিন পড়াশোনা চালিয়েছিলো। দুই-একটা টিউশনি করতো সে। আর তাই দিয়ে নিজের পাঠব্যয় চালিয়ে নিতো। এমন পরিশ্রমি মেয়ের মৃত্যু সংবাদ যখন তার বাবা-মা পেলেন, তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল? পৃথিবীর আর দ্বিতীয় কোনো বাবা-মা সেটা কোনোদিন বুঝতে পারবে না।
ফওজিয়ার এমন করুণ মৃত্যুকে তার বাবার মনের ভেতর দিয়ে কী ঝড বয়ে গেছে তখন, মায়ের বুকের ভেতর দিয়ে তখন কেমন দুঃখ বন্যা বয়েছিল? এ হতভাগ্য দম্পতির সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে এখন কী অসহ্য অমেয় বেদনার পাহাড চেপে বসে আছে! আমরা তা কল্পনাও করতে পারছি না। ফওজিয়ার ছোট ভাইদের অঝোর কান্নার এই চাপ কি আমার নিতে পারছি। তাদের কী প্রাণবন্ত একটা বোন ছিল। যে নোবিপ্রবি’র সেরা একটি সাবজেক্টে পড়তো। কি অবলীলায় বন্ধুদের সঙ্গে মিশতো, গল্প আড্ডা আর খুনসুটিতে কাটতো ফওজিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। শিক্ষকদের দেয়া লেকচার অ্যাসাইনমেন্ট ও সময়ে সময়ে দেয়া দিকনির্দেশনা মেনে ক্যারিয়ার সাজানোয় ব্যস্ত ছিলো সে। তার করা হ্যান্ড নোট এখনো নোবিপ্রবি ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় পাস করার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু আমাদের সে ফওজিয়া আজ আকাশের পানে তাকিয়ে শুয়ে আছে মাটির কবরে। আর চাঁদের আলোতে কবরের ঘাসে ঝিকমিক করছে তার প্রাণোচ্ছ্বল অবিরাম সেই হাসি। এসব নিয়ে ফওজিয়ার বন্ধুরা ফেসবুকে এখন শোকগাঁথা লিখছে। কিন্তু ফওজিয়া আর কোনোদিন ফেসবুকে বন্ধুদের লেখার উত্তর দিবে না। নিজের ওয়ালে লিখবে না, সে কেমন আছে। কেমন থাকতে চায়। এমন সব স্মৃতি আর নস্টালজিয়ায় যেন আর পুড়তে না হয় তাই ভেবে ফওজিয়ার বাগদত্তা মনির হোসেনও নোবিপ্রবি’র চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ইফতেখার হোসাইন |
তবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর দ্রোহের অঙ্গীকার নিয়ে ফওজিয়ার ঘাতকদের গ্রেপ্তার চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ভয়ানক দুর্ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সব দল আর মতের লোকেরা আজ উচ্চকণ্ঠ ও একাত্ম। অচিরেই এ নির্মম ঘটনার বিচার সবাই দেখতে চায় সকলে। কোনোভাবেই অন্যান্য ঘটনার মতো বিলম্বিত যেন না হয় এর বিচার কাজ। ফওজিয়ার মৃত্যুতে দোষীদের গ্রেপ্তারের আর প্রতিবাদের মিছিল আরো বড় হোক। এ প্রতিবাদ থেকে প্রগতি ছড়িয়ে পড়ুক। প্রতিবাদের আগুন আমাদের চেতনায় মশাল হয়ে জ্বলুক। আর রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে যেন বিন্দুমাত্র গড়িমসি না করে। ড্রাইভার থেকে শুরু করে প্রত্যেক পেশাদার ব্যক্তিও যেন নিজেকে শুদ্ধ করতে ব্রতী হয়। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র যেন সড়কে যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধানে তৎপর হয়। প্রতিটি সড়ক হয় যেন শান্তির, সড়ক যেন মৃত্যুর মিছিলে পরিণত না হয়।
- লেখক: ইফতেখার হোসাইন, জনসংযোগ কর্মকর্তা