।। রুদ্র মাসুদ ।।
পাঁচ মাসেরও বেশি সময় অপো করছিলাম প্রকাশনা বার্ষিকী সংখ্যাটি (প্রিন্ট কপি) পাঠকের হাতে পৌঁছাতে। এপ্রিলের মাঝামাঝি যখন এনিয়ে কাজ শুরু করি তখন এবারের বিশেষ সংখ্যাটির নাম দিয়েছিলাম ‘আগামির নোয়াখালী’। তারপর লেখা আহবান, বিজ্ঞাপন খোঁজা। এবার ‘ওয়ানম্যান শো’ চলমান নোয়াখালী’ কে সাজাতে চাইলাম গোটা জেলার উন্নয়ন সংবাদ ও সংশিষ্ট বিশেষ নিবন্ধ দিয়ে। সহযোদ্ধা সাংবাদিক বন্ধুদের সহযোগিতা চাইলাম- কিন্তু সেই সংবাদ আর নিবন্ধ পেতে অপোর পালা যেনো শেষ হয় না।
সবচেয়ে নাকাল হতে হয়েছে নোয়াখালীর সামগ্রিক উন্নয়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা ঐকমত্য নিয়ে অন্তত একটি লেখা নিয়ে। কারো কাছ থেকেই যুতসই সাড়া মিলেনি এ লিখাটির জন্য। কারণ কেউ আসলে নোয়াখালীর অসহিষ্ণু রাজনৈতিক নেতৃত্বের রোষানলে পড়তে চায় না। কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিশেষ করে বড় দুই দলের নেতাদের মধ্যে গণমানুষের উন্নয়ন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও চরদখল, টেন্ডার ভাগাভাগি কিংবা টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলোতে চমৎকার (!) একটা সমঝোতা বজায় থাকে সব সরকারের সময়েই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতোই দৈন্য আমাদের সাংবাদিকতাও। তারপরও আমাদের আহবানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা দিয়ে অনুরোধ রা করেছেন যারা তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। তবে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও সুহৃদ বিজ্ঞাপন দাতাদের সমর্থন ছিলো চলমান নোয়াখালীর প্রতি। কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতিও।
দেশের পুরাতন জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সবসময় সারাদেশে আলোচিত জেলা হচ্ছে নোয়াখালী। বিশেষ করে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প উদ্যোগ, রাজনীতি কিংবা অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর সাথে এ জেলার গর্বিত সন্তানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য নিজ জেলার মানুষগুলোর প্রতি আমাদের গর্বিত সন্তানদের দায়িত্ব বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। এ জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠি তথা গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়ন বিশেষ করে আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরির্তনে তারা যেমন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেনা তেমনি অতীবগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে জেলায় ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বও রীতিমতো থেকেছে অন্ধকারে। অথচ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়ে উঠতে পারতো নোয়াখালী। সেটি হয়নি। যেটি কুমিলা কিংবা রংপুরসহ অন্যান্য পুরাতন জেলাগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আমরা অবশ্যই স্মরণ করছি বিগত দিনগুলোতে যেসকল রাজনীতিবিদ এবং জনপ্রতিনিধির হাত ধরে নোয়াখালীতে চোখে পড়ার মতো যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্পাঞ্চল কিংবা প্রশিণ কেন্দ্র হয়েছে নোয়াখালীতে। আগামি দিনেও আমাদের নেতৃত্ব নোয়াখালীকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে সময়ের সাথে তালমিলিয়ে এমনটি প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।
তবে ১/১১’র পরবর্তী দুই বছরের দিকে তাকালে এবং মূল্যায়ন করলে যে কারো মনে হতে পারে নোয়াখালীতে আরো অনেক কিছু হতে পারতো যা হয়নি। বারবার শুধুমাত্র অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে ভোট হাতিয়ে নিয়েও যেসকল নেতা জনগণের কথা বেমালুম ভুলে যান- এমন নেতৃত্ব নিয়ে অবশ্যই আগামি দিনে আমাদের ভাবতে হবে। কারণ একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র ক্ষমতায়িত হয়েই নয়, আন্তরিক হলে কি হতে পারে না এমনটি নিশ্চয় গত দুটি বছর নোয়াখালীবাসী দেখেছে।
আগামির নোয়াখালী বিনির্মাণে আমাদেরকে অবশ্যই বিষয়গুলো বিচেনায় আনতে হবে। কারণ শুধুমাত্র সুখে বগল চাপড়ালে হবে না আমাদের শির উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগগুলোকেও যেমন কাজে লাগাতে হবে তেমনি সম্ভাব্য বিপদসমূহ মোকাবেলায়ও উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
পাঠক নিশ্চয়ই জানেন নোয়াখালী একটি খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা। আমাদের কৃষি সংশিষ্ট বিভাগগুলো সবসময়ই একথাটি প্রচার করে আমাদের সন্তুষ্ট রেখেছে। তারা ফলাও করে বলেনা শুধুমাত্র সেচ সংকট, জলাবদ্ধতা সেচ সংকটের কারণে নোয়াখালীতে প্রতি বছর সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন খাদ্য কম উৎপাদন হচ্ছে। নোয়াখালীর আঞ্চলিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতে তথা জাতীয় অর্থনীতিকে স্বাভলম্বী করতে এই বিপুল পরিমান অনুৎপাদিত খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া আমাদের শুরু করতে হবে। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে জেলার কৃষি ব্যবস্থায়ও বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকেও। এজন্য চাই স্বল্প সময় এবং পরিবেশবান্ধব বীজ, যথাসময়ে সেচের নিশ্চয়তা সর্বপরি একটি কার্যকর পরিকল্পনা।
শুধুমাত্র কৃষি নয় আমাদের জেলায় যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনউদ্যোগ বিশেষ করে কারু শিল্প, দুগ্ধ উৎপাদন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সারা বছর কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদেরকে একটি মজুবত ভিত তৈরি করে দিতে হবে। চাই শিল্পবান্ধব পরিবেশ এবং উপযোগী অবাকঠামো উন্নয়ন ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। এজন্য প্রয়োজন পুঁজির সংস্থান, প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থার সাথে টিকে থাকার জন্য আধুনিক প্রশিণ এবং বাজার সৃষ্টি। মনে রাখতে হবে শিল্পপন্যের বাজার সৃষ্টি হলও শুধুমাত্র বাজার ব্যবস্থার কারণে আমাদের দুগ্ধ উৎপাদক এবং সব্জি উৎপাদকরা বঞ্চিত হচ্ছে। আগ্রহ হারাচ্ছে প্রান্তিক কৃষক।
উল্লেখিত বিষয়গুলো দ্রুত বিবেচনায় আনা যেমন জরুরী তেমনি বিষয়গুলো জনপরিসরে তুলে ধরে জনমত গঠনে গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ জেলার স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো এবং জাতীয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিরাও কখনো কখনো এ বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ঢামাঢোলে শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টিই সামনে এসেছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে নোয়াখালীকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নিজেদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনায় আনা এখন সময়ের দাবি। আর এজন্য চাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ এখানকার কৃষকের দীর্ঘদিনের দাবি বীজ উদ্যান প্রতিষ্ঠা, উপকূলীয় মানুষের জানমাল রক্ষায় দ্রুত বেড়ি বাঁধ-কিল্লা কিংবা সাইকোন সেন্টার নির্মাণ, উপকূলে জেগে ওঠা নতুন ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার, জেলার দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসনের মতো বিষয়গুলো রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের মধ্য দিয়েই সম্ভব। কারণ আমাদের চোখের সামনেই ইতোমধ্যে অর্ধলক্ষ একরের অমূল্য বনভূমি উজাড় হয়েছে যা রায় আমাদের নেতৃত্ব কিছুই করতে পারেনি। ঘূর্ণিঝড় আইলার ঝাঁকুনি আমাদের সেই বিষয়টি নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে।
এ কথাগুলো উল্লেখ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ যেমন রেখেছে তেমনি বিশেষ বিশেষ এলাকাকে নিয়ে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন (অঞ্চল) করার পরিকল্পনার বিষয়টিও বলছে। তাই নিজেদের গুরুত্ব ( Importance ) জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে একমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর নোয়াখালীর সদর-সুবর্নচর আসনের সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী সম্ভাবনাময় অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে দেনদরবার এবং জেলা পর্যায়ে ভিন্ন মতের রাজনৈতিক নেতাদের উন্নয়ন সংশিষ্ট বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন। এটি একটি শুভ লক্ষণ। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখাবেন না। যার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সমৃদ্ধ আগামির নোয়াখালী।