আজ (১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার) বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো: রুহুল আমিনের ৩৮ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। একাত্তরের এ দিনে তিনি যুদ্ধজাহাজ পলাশ এ শাহাদাৎ বরণ করেন। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার দেউটি ইউনিয়নের শহীদ রুহুল আমিন নগরে (বাঘপাচড়া গ্রামে) বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো: রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর না আয়োজনের মধ্যদিয়ে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১০টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ১০টা ১৫ মিনিটে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো: রুহুল আমিনের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন, সাড়ে ১০টায় শিশু কিশোরদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, বিকেল ৫টায় আলোচনা সভা ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মঝে পুরস্কার বিতরন এবং সন্ধ্যা ৬ টায় মিলাদ মাহফিল। এছাড়া নোয়াখালী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ এদিন বিকেলে বিজয় মঞ্চে শহীদ রুহুল আমিন স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো: রুহুল আমিন ১৯৩৫সালে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘঢাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী, মাতা জোলেখা খাতুন। রুহুল আমিন বাঘঢাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমিষাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নৌ-বাহিনীতে যোগদান করে আরব সাগরে অবস্থিত নানোরা দ্বীপে পিএনএস বাহাদুর-এ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি পিএনএস কারসাজে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পিএনএস কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর রুহুল আমিন আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্রগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌ-ঘাটিতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১ এর এপ্রিলে ঘাটি থেকে পালিয়ে যান। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গঠিত হলে কলকাতায় চলে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে দুটি গানবোট উপহার দেয়। গানবোটের নামকরণ করা হয় পদ্মা ও পলাশ। রুহুল আমিন পলাশের প্রধান ইঞ্জিন রুমে আর্টিফিসার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন।
যেভাবে শহীদ হলেন: ৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর পদ্মা, পলাশ এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট ‘পানভেল’ খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌ-ঘাটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দ্যেশে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে অনেক উুঁচুতে তিনটি জঙ্গি বিমান উড়তে দেখা যায়। শত্র“র বিমান অনুধাবন করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্র নাথ ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষণ পর বিমানগুলো থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নেমে আসে এবং আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। গোলা সরাসরি ‘পদ্মা‘র ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধস্ত করে। হতাহত হয় অনেক নাবিক। পদ্মা’র পরিনতিতে পলাশের অধিনায়ক লে. কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশে ক্ষিপ্ত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে তিনি ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলো চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। শহীদ হন রুহুল আমিন। রূপসা নদীর পাড়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হিসেবে দেখতে চান এলাকাবাসী
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো: রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরকে আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানানোর সকল সুযোগ সুবিধাসহ মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হিসেবে দেখতে চান নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেউটি ইউনিয়নের শহীদ রুহুল আমিন নগরে (বাঘচাপড়া) থাকা শহীদের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী। এলাকাবাসী স্বাধীনতার ৩৮ বছরেও এই বীরের গ্রামে একটি শহীদ মিনার নির্মিত না হওয়ার বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন।
শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের নাতি (বড় মেয়ে নুরজাহানের ছেলে) মোঃ সোহেল চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন সময় তাঁরা সরকারের কাছে তাদের নানার গ্রামের বাড়িতে তাঁর (বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের) স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু একটা করার দাবি জানিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সরকারগুলো বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাদের সেই দাবির বাস্তবায়ন হওয়ায় তাদের পাশাপাশি গোটা রুহুল আমিন নগরবাসী আজ গর্বিত। তিনি জানান, ২০০৮ সালের গত ১২ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রদান মইন উ আহমেদ শহীদ মো: রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কমপ্লেক্সটি দেখাশোনার জন্য একজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং বিদ্যুৎ বিলসহ আনুসাঙ্গিক খরচও জেলা পরিষদের থেকে দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো জানান, তাঁর মা ও মামাদের দান করা ২০ শতক জমির উপর নির্মিত এ শহীদ মো: রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে বিভিন্ন সময়ে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারকে দেওয়া সরকারি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পদকের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন বই, উপন্যাস, ধর্মীয়বই, ছোটদের বই এবং সেনাপ্রধানের দান করা দুইসেট কম্পিউটার স্থান পেয়েছে। তবে; বইয়ের সল্পতার কারণে গ্রন্থাগার হিসেবে এটি এখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর দেখতে আসা দর্শণার্থী একই এলাকার কলেজ ছাত্র মোর্শেদ আলম জানান, তারা আসা করছেন সরকার এই স্মৃতি কমপ্লেক্সকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্মলিত একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হিসেবে গড়ে তুলবেন। যাতে অত্র অঞ্চলের তার মতো নতুন প্রজন্মের সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে। তবে; স্বাধীনতার ৩৮ বছরেও এই বীরের গ্রামে সকরারিভাবে কোন শহীদ মিনার নির্মাণ না হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের বলেন, জাতীয়ভাবে স্বীকৃত এ মহান বীরের বাড়ি তাদের গ্রামে হওয়ার পাশাপাশি তাঁর নামে গ্রামের নাম এবং স্মৃতি জাদুঘর নির্মিত হওয়ায় তারা নিজেদের খুবই গর্বিত মনে করছেন।
বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামের বাড়িতে বর্তমানে তাঁর ছেলে শওকত আলী (কিছুটা মানসিক রোগী) ও তাঁর স্ত্রী রাবেয়া বেগম এবং তাদের চারবছর বয়সের একমাত্র কন্যা সন্তান রয়েছেন। বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার হিসেবে সরকারের দেওয়া ভাতার টাকায় এবং বোনদের সহযোগীতায় তাদের সংসার চলছে বলে জানান বীরশ্রেষ্ঠের ছেলে শওকত আলী। পিতার নামে সরকারিভাবে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হওয়ায় তাঁর (বীরশ্রেষ্ঠ) বীরত্ব এবং এই দেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মানুষ আরো বেশী জানতে পারবে বলে জানান তিনি।
- আবু নাছের মঞ্জু