আবু নাছের মঞ্জু, নোয়াখালী:
হাইব্রিড ধান ঝলক চাষ করে নোয়াখালীর কয়েক হাজার কৃষক এখন দিশেহারা। জেলার বিস্তীর্ণ ফসলী জমির ঝলক ধান পোক্ত হওয়ার আগেই শীষ শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে নোয়াখালীতে এবার অন্তত চার হাজার মেট্রিক টন বোরো উৎপাদন কম হবে। অন্যদিকে ফসল হারিয়ে কৃষকদের এখন পথে বসার অবস্থা।
কৃষক ও কৃষিবিদদের ভাষ্যমতে, মূলত বীজ বিপর্যয়ের কারনেই এমনটি ঘটেছে। এনার্জি প্যাক এগ্রো লিমিটেড নামের একটি বীজ কোম্পানি চীনের উইনার হাইটেক সিড কোম্পানি উৎপাদিত ঝলক (এগ্রো জি ১) নামের এই বীজ বাজারজাত করে।
ধান জ্বলে যাওয়ার ঘটনা স্বীকার করে এনার্জি প্যাকের লোকজন এজন্যে ব্লাস্ট রোগের দোষ দিচ্ছেন। আর কৃষি বিভাগ বলছে- ধানটি তাপমাত্রার অনিয়মীত হ্রাস-বৃদ্ধি সহায়ক নয় বিধায় হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে। অন্যদিকে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববীদদের মতে বীজের হাইব্রিডেশন সঠিকভাবে হয়নি বলেই এমনটা হয়েছে।
নোয়াখালী কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগ জানায়, জেলার মোট এক হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে এবার হাইব্রিড ধান ঝলকের চাষ করা হয়। এরমধ্যে ৪৬৫ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি এবং বাদবাকি জমিগুলো ফসলও অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগের প্রাথমিক হিসেবে এরফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার মেট্রিক টন বোরো উৎপাদন কম হবে বলে তথ্য দেওয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষি সংশ্লিষ্টদের হিসেবে শেষ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমান চার হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বোরো মৌসুমে এলাকার অনেকে প্রথম বারের মতো ঝলক ধানের চাষ করেন। সেবার ফলনও হয়েছিল ভালো। চাল চিকন ও ভাত সুস্বাদু বলে এবারও তাঁরা ঝলকের চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দেখাদেখি অনেক কৃষক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় (যদিও প্যাকেটের গায়ে মূল্য ধরা হয়েছে ২৫০ টাকা) প্রতিকেজি বীজ কিনে ধানটি চাষ করেন। এ বছরও থোড় আসার আগ পর্যন্ত ধানের বৃদ্ধি দেখে কৃষকের মনে ভালো ফসল ঘরে তোলার আশা জাগে। কিন্তু এক পর্যায়ে শীষ বেরিয়ে ধান দানা বাঁধার আগেই শীষ শুকিয়ে যেতে থাকে। শুরুতেই এনিয়ে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর কোনো সহযোগিতা না পেয়ে কৃষকরা এর ওর পরামর্শে জমিতে বিভিন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করেন। এতেকরে কীটনাশক বিক্রেতারা লাভবান হলেও কৃষকের একবিন্দুও লাভ হয়নি।
সরজমিনে দেখা যায়, সবুজ ফসলের মাঠে অনেক ক্ষেত সোনালী হয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ধান পেকে আছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায় ধান পোক্ত হওয়ার আগেই শীষ শুকিয়ে গেছে। যেখানে হয়তো একজন কৃষক ২০ মন ধানের আশা করেছিলেন; সেখানে ২০ কেজি ধানও নেই।
কথা হয় সোনাইমুড়ি উপজেলার কেশারখিল গ্রামের কৃষক আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি জানান, নিজের ১০ গণ্ডা জমিতে ঝলক ধান লাগিয়েছেন। আমিশাপাড়ার এক ডিলারের কাছ থেকে ২৭০ টাকা দরে তিন কেজি বীজ কেনেন তিনি। তাঁর জমিতে থোড় আসার পর সব শীষ শুকিয়ে যায়। কীটনাশক ছিটিয়েও ফলন রক্ষা করতে পারেননি তিনি। ‘এই জমির ধানটাই আমার ছয় সদস্যের পরিবারের দশ মাসের খোরাকির যোগান দেয়। গত বছরও ২০ মন ধান পেয়েছিলাম; এবারতো ২০ কেজি ধানের আশাও নেই’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন আবুল কাশেম।
গণমাধ্যমের লোক এসেছে শুনে বহু কৃষক সেখানে জড়ো হন। সবাই ঝলক ধানের চাষ করেছেন। কেউ কেউ ঝলকের সঙ্গে অন্য জাতের ধানও চাষ করেন। তবে অন্য জাতের ধানগুলো সমস্যামুক্ত থাকলেও প্রত্যেকের ঝলকের ক্ষেতগুলো ঝলসে গেছে। এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় এক করুন দৃশ্যের অবতারনা হয় সেখানে। বর্ণনা দিতে গিয়ে কাশেমের মতো আরো অনেকেই কেঁদে ফেলেন।
বরপাড়া গ্রামের বর্গাচাষী বাবুল এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা রিন নিয়ে ৩৪ গণ্ডা জমিতে ঝলক ধান লাগিয়েছেন। বললেন, ‘ক্ষেতেই আইলে গ্যালে কইলজা হাডি যায়। সব ধান চিডা হই গেছে।’
উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, আমিশাপাড়া ইউনিয়নের ৫০ হেক্টর জমির ঝলকের ফসল আক্রান্ত হয়েছে।
বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাদী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন চৌধুরী জানান, তাঁর নিজের এক একর ৬০ শতাংশ জমিতে এবং তাঁর ভাই আবদুর রাজ্জাকের দুই একর ৬০ শতাংশ জমিতে এবার ঝলক ধানের চাষ করা হয়। থোড় আসার দুই দিনের মধ্যে কোনকিছু বুঝে উঠার আগে পুরো জমির ধান শুকিয়ে যায়। তিনি বলেন,‘ধানতো নেয়ই; খড়গুলোও গরুকে খাওয়াতে পারছিনা; যদি গরু মরে যায়া এই ভয়ে’।
উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আবু তাহের ভূঞা জানান, একলাশপুর ইউনিয়নের ৩০ হেক্টর জমিতে ঝলকের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে কমবেশি সবগুলো জমিই আক্রান্ত। নাজিরপুর গ্রামের আবদুর রাজ্জাকে আড়াই একর, পূর্ব একলাশপুরের সলিম উল্লার এক একর জমির পুরো ধান চিটা হয়ে গেছে।
একইভাবে চাটখিল পৌর এলাকার আবুল কাশেমের এক একর, ছয়ানী টগবা গ্রামের আবদুল মান্নানের ১২০ শতাংশ, কবির হোসেনের ৭০ শতাংশ জমির ধান চিটা হয়ে গেছে।
ঝলকের ফলন বিপর্যয় নিয়ে কথা হয় নোয়াখালী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক নৃপেন্দ্র কুমার সরকারের সাথে। তিনি বলেন, ‘এটি বীজবাহিত চত্রাক জনিত একটি রোগ। তাপমাত্রা একদিনে ৩৫ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রিতে নেমে গেলে এমটা হতে পারে’। ডিলারা রশিদ না দিয়ে কৃষকদের কাছে বীজ বিক্রি করছে বলে সংশ্লিষ্ট বীজ কোম্পানিগুলো পরবর্তীতে দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। বিষয়টিতে ডিলাদের নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ বিএডিসিকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপরেশন (বিএডিসির) বীজ বিভাগের উপ পরিচালক রুহল আমিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত দু:খজনক। কৃষকের পুরো ক্ষতির দায় সংশ্লিষ্ট বীজ কোম্পানির। আমরা মাঠ পর্যায়ে আরো খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব’।
বিএডিসি’র জেলা বীজ ও সার এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সাহাব উল্যা বলেন, ‘ফলন বিপর্যয়ের পর আমরা বীজ কোম্পানির লোকদের সাথে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাচ্ছিনা। রশিদ ছাড়া বীজ বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা ক্রয়কৃত বীজ বিক্রি করি, রশিদ দিয়ে কেন দায়দায়িত্ব নিজের ওপর নেব। তাছাড়া সারা দেশে যেহেতু একই অবস্থা। তাই বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তেও উপর নির্ভর করছে’।
এনার্জি প্যাকের কুমিল্লা জোনের প্রোডাকশন ম্যানেজার আবদুল হামিদ ঝলকের ফলন বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ব্লাট রোগের কারনে এমনটি হতে পারে’।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য কৃষিবীদ অধ্যাপক একেএম সাইদুল হক চৌধুরীর মতে, যেকোন হাইব্রিড বীজের ক্ষেত্রে ইকোসিস্টেম অর্থাৎ মাটি ও আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি অত্যন্তত গুরুত্বপূর্ন। তাই দেখা যায় একক অঞ্চলে একক ফসল ভালো হয়। অন্যদিকে ফলনের ক্ষেত্রে বীজ, মাটি, আবহাওয়া, পরিচর্চা এবং সময় মতো সার ও কিটনাষক প্রয়োগের বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হয়। এর যেকোন একটি ব্যত্যয়ের কারনে এমননি হতে পারে বলে তাঁর ধারনা।
অন্যদিকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববীদ কামরুল ইসলামের মতে, মূলত বীজের সমস্যা বিশেষ করে বীজের হাইব্রিডেশন সঠিকভাবে হয়নি বলে ঝলকের ফলনে এমন হয়েছে।
- আবু নাছের মঞ্জু