মো হা ম্ম দ এ হ তে শা মু ল হ ক
দোলনা পর্বতে
‘বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্হান তাসমানিয়া’। এই ছিল মার্ক হ্যারিসনের কথা। তিনি আমার শিক্ষক, ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ব বাণিজ্যবিধি পড়াতেন অস্ট্রেলিয়ান কাস্টমসের এই সাবেক নির্বাহী। অবসরে যাচ্ছেন। জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে ফিরে যেতে চান তাসমানিয়ায়। ওখানেই তার জন্ম।
শুধু মার্ক কেন, যে-কোনো তাসমানিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেই সোল্লাসে বলে- আকর্ষণীয়তম। পয়সার টানাটানি ছিল। তবু মার্কদের কথা কতোটা সত্য, তা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা তিনজনই। মানে আমি, সঙ্গে কন্যা আর জায়া।
ইচ্ছা ছিল, মেলবোর্ন থেকে ‘স্পিরিট অব তাসমানিয়া’ জাহাজে করে পাড়ি জমাবো। সময় বেশি ছিল না হাতে। ক্যানবেরা থেকেই হোবার্টের উদ্দেশে উড়লাম।
দোলনা পর্বত- ক্রেডল মাউন্টেন। কী যে অবর্ণনীয়! চোখ জুড়ানো এর রূপ। কোনো বিশেষণ এর জন্য যথেষ্ট নয়।
তাসমানিয়া খুব বড় কোনো দ্বীপ নয়। উত্তরাংশের প্রধান শহর লঞ্চেস্টন থেকে দোলনা পর্বত। ড্রাইভ করলে ঘণ্টা দেড়েক, পাবলিক গাড়িতে দুই। আমরা ছিলাম পাবলিক। বাস থেকে যেখানে নামলাম, সেখানেই আমাদের রিসোর্ট- ক্রেডল মাউন্টেন ভিলেজ। পাহাড়ের গা ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে টেনে নিতে হয় লাগেজ। ততোক্ষণে এই শীতেও ঘামছি। কিন্তু লজে পৌঁছেই ক্লান্তি উধাও। বনের মধ্যে ছোট ছোট কয়েকটি কুটির। প্রাকৃতিক আবহ অবিকল রেখে বেশ সতর্কতায় নির্মিত এসব কাঠের ঘর। ভেতরে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ধৌতকরণ ব্যবস্হাসহ আধুনিক উপচার- সবই রয়েছে। কাচের দেয়াল সরিয়ে বারান্দা। ওখানে অপেক্ষা করছে বিস্ময়! অভূতপূর্ব। সামনে অবারিত বনানী। পাখির ডাক। কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি। চাবি নেয়ার সময়ই হোটেলের লোকটা বলে দিয়েছিল, রাতে হায়েনার গোঙানি শুনবেন। ভয় পাবেন না যেন। ওটা হায়েনা নয়, তাসমানিয়ান ডেভিল। দেখতে হায়েনার মতো হলেও ওরা বিশেষ এক প্রজাতির জীব। কিছুটা হিংস্র। তবে জনপদে হামলা করে না।
স্টুডিও লজ। রূপা ঝটপট খিচুড়ি রেঁধে নিল। খাওয়ার পর বারান্দায় আড্ডা, আর কফির মগে চুমুক। আহ্! লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল। আমার মেয়ে বিভোরের সঙ্গে কয়েক রাউন্ড লুকোচুরি খেলেই তৈরি হয়ে যাই। দোলনা পর্বত দেখতে যাবো।
পরিবেশ রক্ষায় ওরা সচেতন। যন্ত্রযান নয়। প্রায় দশ কিলোমিটার পথ যেতে হবে ব্যাটারিচালিত বাসে। ভাড়া লাগে না। বাস ছাড়ে ভিজিটর সেন্টার থেকে, আধঘণ্টা পর পর। ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি ফি সাড়ে ষোলো ডলার। মিনিট দশেকের পথ।
পার্ক মানে ক্রেডল মাউন্টেন লেক সেন্ট ফ্লোয়র ন্যাশনাল পার্ক। তাসমানিয়ার ওয়েস্টার্ন ওয়াইল্ডারনেস হেরিটেজ এরিয়ার পুরোভাগে দোলনা পর্বত। পর্বতের পায়ের কাছে শান্ত পানির ডাভ হ্রদ।
লেকের পাশে যখন পৌঁছাই, তখন বেলা তিনটা। আকাশে মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি। লেকের চারপাশে কাঠের পাটাতনের বোর্ডওয়াক। কোথাও উঁচু-নিচু। পুরোটা ঘুরে আসতে দু’ঘণ্টার মতো লাগে। অন্য প্রান্তটা দোলনা পর্বতের লাগোয়া।
ভাবনা শুধু একটা। ব্যাটারিচালিত শাটল থাকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এর পরে জনমনিষ্যির অস্তিত্ব থাকে না। পথঘাট আছে, তবে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে পড়ে সন্ধ্যার পরপরই। তার ওপর বিভোরের স্ট্রলার ঠেলে নিতে হবে।
কিন্তু আমি যাবোই যাবো। এই অপার সৌন্দর্যের যতোটা পারি রসাস্বাদন করে যাবো। যুক্তি নয়, শেষ পর্যন্ত ইচ্ছাই জিতলো। লেকের এক পাড় ধরে হেঁটে যেতে থাকলাম। আমরা শুধু নয়, অনেকেই আছে। কিন্তু বিভোরের মতো ছোট শিশু নিয়ে কাউকে দেখছি না। হাঁটছি, আর দেখছি চারপাশ। ক্যামেরায় অবিরত চলছে ক্লিক ক্লিক। সুযোগ পেলেই পা ডোবাচ্ছি ঠাণ্ডা পানিতে। কী ভালো যে লাগছিল!
লেকের চারপাশে আলস্টাইন বন। নানা চেনা-অচেনা গাছ আর গুল্ম। একটু পর পর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসি। এভাবেই আলোর উৎসের সঙ্গে চলছিল লুকোচুরি। সিঁড়ির পাশে এলে দুজনে মিলে স্ট্রলার পার করছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দোলনা পর্বত একেবারে স্পর্শের কাছাকাছি।
লম্বাটে লেকটার চারপাশে পর্বতের সারি। এর মাঝে যে দুটি সবচেয়ে উঁচু, ওদের মাঝে আবার ছোট্ট উপত্যকার মতো খানিকটা জায়গা। সব মিলিয়ে দেখতে অনেকটা দোলনার মতো। নামটা এ জন্যই ক্রেডল মাউন্টেন। প্রাকৃতিক লেকের পানির যে কী রঙ! কোথাও সবুজ, কোথাও নীল। আবার এক জায়গায় দেখি হলুদ। পরে বুঝলাম, এক বিশেষ ধরনের গাছের পাতা পড়ে এমন হয়েছে।
মাঝপথ পর্যন্ত দুলকি চালে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি, পাঁচটা বাজতে চলেছে। পাঁচটার মধ্যে না পৌঁছালে বিপদ। স্ত্রী আর দেড় বছরের বিভোর। কী যে হবে? রূপা ততোক্ষণে ঝাল মেটাচ্ছে আমার ওপর, আগেই বলেছিলাম। পড়িমরি করে ছুটছি। শুধু মনে হচ্ছে, শাটল মিস করলে দশ কিলোমিটার পথ হেঁটে ফিরতে হবে, বুনো পথে। আর এই বনে ভালুক আর হায়েনা ছাড়াও আছে তাসমানিয়ান ডেভিল।
এদিকটায় পথও এবড়োথেবড়ো। স্ট্রলার গুটিয়ে নিলাম, বিভোর কোলে। এভাবেই ছুটছি। প্রকৃতির শোভা নিয়ে মাতামাতি ততোক্ষণে হাওয়া। ডেভিলের চোখ নিয়ে ভাবছি। ঘামতে ঘামতে অবশেষে শাটল ছাড়ার মিনিট পাঁচেক আগে ফিরে আসি। ক্লান্ত দেহ। তিনজনেরই। ক্ষুধায় বিভোরের মুখটা শুকিয়ে আছে। আজ আর রান্না নয়। ভিজিটর সেন্টারের পাশে রেস্তোরাঁয় ডিনার শেষে ঘরে ফিরি। মনে পড়ে, বিভোর ঘুমিয়ে পড়ার পরও ঘণ্টা দুই-তিন চলেছিল আড্ডা।
পরদিন সকালে আবার ডাভ লেক দেখবো বলে বেরোচ্ছি। রেস্তোরাঁয় কয়েকজন বলেছিলেন, লজের আশপাশেও জায়গাটা দারুণ। বেশ কয়েকটা বোর্ডওয়াক আছে, আর পাখ-পাখালি, গাছ-গাছালির দারুণ সমাহার। এখানেও রয়েছে আরেকটা লেক। এর পাশ দিয়ে বনে প্রবেশের পথ। হাতে ম্যাপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
পথে পড়লো কয়েকটি ঝরনা। মনমাতানো ছন্দে পানির শব্দ, সঙ্গে পাখির কলতান মিলে তৈরি হয়েছে দারুণ সুরলহরি। দুপুর পর্যন্ত এই ঐকতানে মিশে ছিলাম। আজ আর বেশি দূরে যাবার সাহস নেই।
যতো দেখছি, ততোই বাড়ছে মুগ্ধতা। আফসোস হচ্ছিল, বিভোরটা এত্তো ছোট। ওর হয়তো কিছুই মনে থাকবে না।
লজে ফিরে কিছুক্ষণ খেলা চললো কাঠবিড়ালির সঙ্গে। ইশ্! এই রকম একটা জায়গায় কেন যে দিনের পর দিন থাকা যায় না। মার্ক, কপাল তোমার!
- লেখক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
- ছবি: লেখক