মো হা ম্ম দ এ হ তে শা মু ল হক
হঠাৎ মধ্য আটলান্টিকে
আংরা দো হিরোইসমো। আটলান্টিকের মধ্যিখানে বাঁধ, ছোট-বড় গির্জা, সৈকত আর পাহাড়শোভিত দ্বীপ। শ্বাসরুদ্ধকর জরুরি অবতরণের সূত্রে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন মোহাম্মদ এহতেশামুল হক
দিনভর ছুটেছি। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে প্লেনে আসন নিলাম। বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার। চোখ ভেঙে নামছে ঘুম। টেক-অফের আগে চোখের পাতা এক করবো না- এমনই ভেবেছিলাম।
পাতা ওল্টালাম লুফথহানসার ইন-ফ্লাইট ম্যাগাজিনে। সম্পাদক লিখেছেন, ইউ আর সেফ। কোনো যাত্রী যদি চৌদ্দ হাজার বছর ধরে প্রতিদিন ফ্লাই করেন, পরিসংখ্যান বলে, তার একবার বিমান দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা। তাই নাকি? হাজার হিসাব চলতে লাগলো। উদ্দেশ্য, মাথাটাকে কিছু একটা নিয়ে সক্রিয় রাখা। কিন্তু হলো না। নিরাপত্তার আনন্দ কেড়ে নিল সংশয়-ভয়। এক হলো দু’চোখের পাতা।
এটা ফ্রাংকফুর্ট বাউন্ড ফ্লাইট। মেক্সিকো সিটিতে সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরছি। ফ্রাংকফুর্ট থেকে দোহা হয়ে ঢাকা। ইচ্ছা করেই লুফথহানসা নিয়েছি। জার্মান প্রযুক্তির ওপর আস্হা। যেমন আস্হা ছিল লোথার ম্যাথিউস আর যুর্গেন ক্লিন্সমানের ওপর।
বোয়িং ৭৪৭-এর একেবারে পেছনের দিকে সিট। ঘুমে অসাড়। দু’তিন ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙল। প্রচণ্ড গরমে। ঘামছি। টের পেলাম, প্লেন তখনো টেক-অফ করেনি। পাশের যাত্রীর কাছে যা শুনলাম, তাতে বিরক্তি চাপতে পারলাম না। তবে চমকিত হলাম।
প্রথমে বলেছে, ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না। পুরোপুরি ঠিক হওয়ার আগে আকাশে ওড়া ঝুঁকিপূর্ণ। এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও বাংলাদেশের সেই টিভির বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়লো, একেএস স্টিলের। গাড়ি ৯৯% ওকে, ভালো কন্ডিশন, শুধু ব্রেকটায় সমস্যা। আনমনে হাসলাম।
ব্রেক নাকি কাজ করছে না। প্রকৌশলীরা ঘামছেন। বলা হলো, এমারজেন্সি ডোর- সব খুলতে হবে। ক্রুদের কে একজন রিয়ার ডোর খুলে ফেললেন, ভুল করে। ব্যস! আরেক বিপত্তি। ওটা আর বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তিন-চার ঘণ্টা পর এক গ্লাস পানি ছাড়া আর কিছু মেলেনি। এ যেন লুফথহানসার বোয়িং নয়, রামপুরা-সদরঘাট রুটের মুড়ির টিন এক্সপ্রেস।
রাত নয়টা বিশ মিনিটের প্লেন আকাশে ওড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর। রাত দু’টায়। ফ্রাংকফুর্টে আমার ছয় ঘণ্টা স্টপওভার। ভাবছিলাম, কী করবো। উড়ালযানের যান্ত্রিক বিপত্তি সে শঙ্কা ঘুচিয়ে দিল।
নিশ্চয় আর কিছু হবে না। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চোখ রাখলাম স্ক্রিনে। ‘লাইফ অব পাই’ দেখবো। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা দেখেছি এ ছবি নিয়ে।
এগারো ঘণ্টার ফ্লাইট। ট্রান্স আটলান্টিক। মেক্সিকো থেকে উত্তর ইউরোপ, প্রায় সাড়ে নয় হাজার কিলোমিটার পথ। প্রায় পুরোটাই সমুদ্রের ওপর দিয়ে। সবই ঠিকঠাক যাচ্ছিল। ডিনার, মুভি শেষ করে ছোট এক রাউন্ড ঘুমও দিয়ে উঠেছি। তখনো শুনি চার ঘণ্টা বাকি; আমরা আটলান্টিকের প্রায় মাঝখানে।
এমন সময়। আচমকা কেবিন ক্রুদের দু’জন ছুটে এলো। এসেই কেবিনের সামনের দিকে দুই নবজাতকের জন্য পাতা বেসিনেট গুটিয়ে নিল। পাইলট সিট বেল্ট বাঁধার সংকেত দিলেন। তখনো কিছু বুঝতে পারিনি। স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। লং ফ্লাইটে প্রায়ই এমন হয়। ঝাঁকুনির আশঙ্কা থাকলে বেল্ট বাঁধতে বলে।
একটু পর শুনি, এমারজেন্সি ল্যান্ডিং। সর্বনাশ। আমরা তো আটলান্টিকের মধ্যখানে। কেন? কী এমন হলো? একটু পর পাইলটের গলা, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে আর ককপিটে ধোঁয়া। ধোঁয়ার কারণ এখনো অজানা। তেমন আতঙ্কের কিছু নেই। ‘অ্যাজ আ প্রিকশনারি মেজার’ আমরা লাজেস বিমানবন্দরে এমারজেন্সি ল্যান্ডিংয়ের চেষ্টা করছি।
কেবিন ক্রুদেরকে ‘ল্যান্ডিং মোড’-এ যেতে বলা হল। দৌড়ঝাঁপ করে চেক করছেন জরুরি নির্গমন পথ, সিট-বেল্ট ইত্যাদি। বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণী একজন ক্রুকে দেখলাম, চোখ মুছছে। দু’গাল বেয়ে পানি। ওকে দেখেই প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম, আমরা কি বিমান দুর্ঘটনার শিকার হতে যাচ্ছি? প্লেন ক্র্যাশ? পাইলট এইমাত্র যা বললেন, এর চেয়ে বেশি সত্য কি কিছু আছে? যা আমরা জানি না, ক্রু জানে? সেই জন্য তাদের মুখ বেশি মলিন। কোনো প্রশ্নেরও জবাব দিচ্ছে না। শুধু বলছেন, পাইলট আপডেট দেবে।
কেবিনে তখন মৃত্যুপুরীর নীরবতা। নিচুস্বরে কথা বলছে কেউ কেউ, সহযাত্রীর সঙ্গে। সবার চোখে ভাষাহীন জিজ্ঞাসা। কী হতে চলেছে? কেউ কেউ ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে ম্যাপ বের করেছে। পাশের যাত্রী জার্মান। এই রুটে মনে হয় নিয়মিতই তিনি; আমাকে দেখালেন আমরা যেখানে নামবো, সেটা দ্বীপদেশ। নাম আজোর্স। কয়েকটা ছোট দ্বীপ আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
এইভাবে কাটলো প্রায় আধঘণ্টা। পাইলট আমাদের এর বেশি কোনো তথ্য দিলেন না। অবতরণের প্রস্তুতি চললো অনেকক্ষণ। অল্প বয়সী ক্রু মেয়েটা তখনো নীরবে কেঁদে চলেছে। আমরা যার যার ধর্ম মেনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছি সেফ ল্যান্ডিংয়ের জন্য। কেউ কেউ চোখ বুজে আছেন, ভয়ে।
রূপা (আমার স্ত্রী) সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলার সময় প্রায়ই বলে, এখন কোনো কারণে প্লেনটা পানিতে পড়লে আমার কী হবে? আমি তো সাঁতার জানি না। মনে হতেই এমন পরিস্হিতিতেও হেসে ফেললাম। যেন পানিতে না পড়ে মাটিতে পড়লেই বেঁচে যাবে!
বিমান দুর্ঘটনায় কোনো যাত্রীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। যাত্রীরা সবাই জানেন সেটা। প্রার্থনা চলছে অবিরত। মনটা বড় বিক্ষিপ্ত। প্রিয়জনদের মুখাবয়ব ভাসছে চোখে। সিনেমায় ফ্ল্যাশব্যাকের মতো। একটার পর একটা দৃশ্য আসছে-যাচ্ছে। কেমন যেন অনুভূতিহীন বোধ করছিলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি শেষ হয়ে যেতে পারেন। এ অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে চেষ্টায়ও যাবো না।
প্রায় আধঘণ্টা আকাশে পাক খেয়ে পাইলট ল্যান্ডিংয়ে গেলেন। সবাই নীরব। নানান আশঙ্কা মনে। অবশেষে নিরাপদ ল্যান্ডিং। রানওয়ে বেশি দীর্ঘ নয় মনে হয়। মাটি ছোঁয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্রেক কষা হলো। যাক, ব্রেকটা কাজ করছে। ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল প্লেন। যাত্রীদের অস্ফুট স্বর আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। হাসি। দু-একজনের চিৎকার, ব্র্যাভো! আহ্। বেঁচে গেলাম। মনে মনে ধন্যবাদ জানাই বিধাতাকে। পাইলটকেও।
লাজেস এয়ারপোর্ট। পাইলট জানালেন, ফায়ারফাইটাররা এসে ধোঁয়ার কারণ অনুসন্ধান করবেন। সব ঠিক থাকলে আমরা উড়বো আবার। নামতে না-নামতেই চারপাশ থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন ঘিরে ফেললো পুরো প্লেন। কর্ডন করে রাখলো। এ আবার কী বিপদ। জানলাম, লাজেসে আমেরিকান আর্মির বেসক্যাম্প আছে। এক পাশে বাণিজ্যবিমানের (যাত্রী চলাচলের জন্য) ওঠানামা চললেও লাজেস মূলত বিমানঘাঁটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ, ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ব্যবüত হয়ে আসছে।
কারণটা অনুমিতই ছিল। এর কৌশলগত অবস্হান। নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৩৬৮০ কিলোমিটার, আর লিসবন (পর্তুগালের রাজধানী) থেকে ১৬০০ কিলোমিটার পশ্চিমে। আটলান্টিকের মাঝ বরাবর। উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের মধ্যিখানে। পরে জানলাম, লাজেস ফিল্ড হলো মাল্টি-পারপাস বিমানবন্দর। আমেরিকা আর পতর্ুগালের যৌথ ঘাঁটি। সঙ্গে আজোর্স এয়ার জোন কমান্ড। একটু দূরে প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল। অবস্হানের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ এয়ার এবং নেভি স্টেশন হয়ে ওঠে লাজেস।
ফায়ারফাইটাররা বেশ কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করে ফিরে গেলেন চারপাশ ঘিরে ফেলা ফায়ার ব্রিগেড ট্রাকে। পাইলট জানালেন, আমাদের ডিসএমবার্ক করতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে কিছুক্ষণ পর হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। সম্ভবত পরদিন পুনরায় আকাশে উড়বে বিমান। বাকি আপডেট মিলবে হোটেলের রিসেপশনে। বিস্ময়, আরেক দফা। এখানে আবার হোটেল আছে নাকি? এবার অবশ্য বিস্ময়ের সঙ্গে ভয়টা নেই। আপাতত বেঁচে তো গেলাম।
ততোক্ষণে ফায়ার ট্রাক সরে গেছে। সে জায়গায় এয়ারপোর্ট শাটল। টার্মিনালে পৌঁছে দেখি লম্বা কিউ। আবহাওয়া ছিল খুবই প্রতিকূল। এয়ারপোর্টে তালা দিয়ে সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিল। এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের জরুরি ফোন পেয়ে দু’তিনজন এসেছেন। আরও দু-একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা নাকি আসবেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর আমার পালা যখন এলো, আরেক ঝামেলা। এটা নাকি ইউরোপে পড়েছে। আমার সেঙ্গেন ভিসা ছিল সিঙ্গল এন্ট্র্রি। যাওয়ার সময় ব্রাসেলসে তিন দিলাম। এখন আবার ইউরোপে কীভাবে যাবো? ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে বোঝাতে চাইলাম, আমি তো স্বেচ্ছায় ইউরোপে আসিনি। এটা অ্যাক্সিডেন্ট। পৃথিবীর কোন প্রান্তে ইমিগ্রেশনের লোক যুক্তির ধার ধারে? ওর নাকি কিছুই করার নেই। লুফথহানসার ক্রুদের খুঁজলাম। কেউ কোথাও নেই। আমাকে দাঁড়াতে বললো এক পাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মতো আরও চৌদ্দ-পনেরোজন পাওয়া গেল। প্রায় সবাই এশিয়ান। বাংলাদেশের আমি একাই। আচ্ছা, আজোর্সে পা রাখা প্রথম বাংলাদেশি আমি নই তো? বিমান দুর্ঘটনা ছাড়া এত দূরে কে আসবে?
আজোর্স দ্বীপপুঞ্জ পর্তুগালের অধীন। লাজেস এই দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে টের্সেইরার এক প্রান্তে। নয়টি দ্বীপ নিয়ে এ দেশ। অন্যগুলো হলো: সাও মিগুয়েল, ফায়াল, পিকো, সাও জর্জ, সান্টা মারিয়া, গ্রাসিওসা, ফ্লোরেস আর কর্ভো। এর আবিষ্কার নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত। স্পেন আর পর্তুগালের নাবিকরা যখন পাল তুলেছেন, তখন কোনো এক সময়ে তাদের পা পড়ে এই দ্বীপগুলোর কোনো কোনোটিতে। একেকজন একেক নামে অভিহিত করেছেন। কেউ বলেছেন ‘পাড়ভূমি; কেউ বলে ‘নীল দ্বীপ’, আর কেউবা ‘টিন-রুপার দ্বীপ’।
মেজাজ তখন তিরিক্ষি। আমরা কয়েকজন ছাড়া সবাই ততোক্ষণে হোটেলে। আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে কয়েকজনকে দৌড়াতে দেখলাম। দেরির কারণ নাকি ভিসা ফি। আমাদের কাছ থেকে পয়সা নেবে না। লুফথহানসার লোকজনকে খুঁজছে পয়সার জন্য। চীন থেকে চার তরুণ-তরুণীর দল এসেছে একটি। জানলাম, এরা মাছ ধরার জাল মার্কেটিং করে বেড়ায় এখানে-ওখানে। দাপ্তরিক কাজেই গিয়েছিল মেক্সিকো। দু-একজন ট্যুরিস্ট। ইন্দোনেশিয়ার একজনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমারই বয়সী। খোশগল্পে তখন আর পোষাচ্ছে না। ক্ষুধাতৃষ্ণায় নাকাল। সবাই চলে যাওয়ার প্রায় দু’ঘণ্টা পর আবার সেঙ্গেন ভিসা পেলাম। তিন দিন মেয়াদ। আমাদের বারো ঘণ্টা হলেই চলতো। এর মাঝে কে যেন হাতের মধ্যে ট্রাভেল ব্রশিউর গুঁজে দিয়েছে। টের্সেইরা আর সাও মিগুয়েল দ্বীপের। ব্রশিউরের পাতা উল্টে বিস্মিত হলাম। এত নয়নাভিরাম দেশ। ইশ্। ঘুরে দেখার সময় মিলতো যদি!
আমাদের দু’ভাগ করে দুটো হোটেলে পাঠানো হলো। একদল গেল এয়ারপোর্টের কাছেই, প্রায়া দো ভিতোরিয়ায়। আর আমরা ১৫ কিলোমিটার দূরে। আংরা দো হিরোইসমোতে। এটাই টের্সেইরার প্রধান শহর। আংরা নামেই চেনে লোকে। আংরা পুরো আজোর্সের একটি আঞ্চলিক রাজধানী। অন্য দুটি হলো পোর্তা দেলগাদা (সাও মিগুয়েল) এবং হোর্তা (ফায়াল)।
আংরা সবচেয়ে পুরনো শহর পুরো আজোর্সে। এবং সম্ভবত প্রথম আবিষ্কৃত। এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও ছিল অনেক। চৌদ্দ ও পনেরো শতকে পর্তুগিজদের নৌবাণিজ্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আংরার। মনে মনে ছক কষে ফেলি। সকালে ঘণ্টা খানেক সময় পেলেও বেরিয়ে পড়বো ট্যাক্সি নিয়ে। বিনা পয়সায় দারুণ পর্যটনের এ সুযোগ হেলায় হারাবো না। ভাবতে ভাবতে চলে এলাম হোটেলে।
হোটেল দো কারাকোল চারতারকা মানের। সুপিরিয়র যে রুমটি দিয়েছে, তা ভালোই। এমন ঘটনার পর এ আতিথ্য আশা করিনি। বলা হলো ডিনার সার্ভড। তাড়াতাড়ি যেন খেয়ে নিই।
বৃষ্টি হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা ধরেই। এখন রীতিমতো ঝড়। এমন হলে সকালে বেরোবো কীভাবে?
রুমের ফোন থেকেই দেশে ফোন করলাম। পরদিন ঢাকায় একমাত্র সম্বন্ধীর হলুদসন্ধ্যা। এ জন্যই দুই সফরসঙ্গীর সঙ্গে আমেরিকায় না গিয়ে একদিন আগেই দেশের ফ্লাইট ধরেছি। কিন্তু একি হলো! স্ত্রীকে ফোন তুলেই বললাম, ভাইয়ার হলুদে থাকা হচ্ছে না আমার। পুরো ঘটনা সবিস্তারে শুনে রূপা ডুকরে কেঁদে উঠলো। আরও একবার মনে হলো, একটা ভয়াল মৃত্যুর শঙ্কা থেকে ফিরেছি আমি। পরে জেনেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেশে নিকটাত্মীয়দের মাঝে এ খবর চাউর হয়ে গেছে। সবাই অস্হির। অনুষ্ঠানের রঙও হয়তো ফিকে হয়েছে কিছুটা।
খাবারে তেমন বিশেষত্ব নেই। আ লা কার্ত দেখে অর্ডার করার সুযোগ নেই। সবাইকে একই খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। আমার টেবিলে রাখতেই জিজ্ঞেস করলাম, পর্ক নেই তো? সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো ওয়েটার। ধর্মীয় কারণে ওটা যে খাই না, জানিয়ে দিলাম। একটু যেন বিরক্তই হলো। অবশ্য অস্বাভাবিক তো নয়। মাত্র তিনজন ওরা। আচমকা অনাহূত এক বিমান অতিথির সেবা করতে প্রস্তুত ছিল না নিশ্চয়! পাশের টেবিলে এক ব্রাজিলিয়ান যুবক মনোহরণের চেষ্টা করছে দুই আইরিশ নারীর। গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে। বিমান দুর্ঘটনার নানা কাহিনীই বেশি। এখানে এর আগেও নাকি এ রকম এমারজেন্সি ল্যান্ডিং হয়েছে।
খাওয়া শেষে একটু হেঁটে আসতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু ঝোড়ো বৃষ্টি। রিসেপশন থেকে জানালো, পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় শাটল এসে আমাদের এয়ারপোর্টে নেবে। তার আগে যেন তৈরি থাকে সবাই। জানতে চাইলাম, ভোরে কি শহরটা ঘুরে দেখা যাবে? কতোক্ষণ লাগবে? ‘আলবৎ’, অতি উৎসাহে জানালো মেয়েটা। আমি চাইলে ও একজন এক্সপার্ট ট্যাক্সি ড্রাইভার কাম গাইডকে বুক করে দিতে পারে। শহরের ট্যুরিস্ট পয়েন্টগুলো ঘুরে দেখতে দু’ঘণ্টার বেশি লাগবে না। বাহ্। এমনই তো চেয়েছিলাম। ঠিক হলো, সাড়ে সাতটায় ট্যাক্সি চলে আসবে। রুমে ফিরে বারান্দায় ঝড় দেখলাম অনেকক্ষণ। আটলান্টিকের ঝড়। অন্য রকম। বাতাসের গতি অনেক। আমাদের উপকূলে জলোচ্ছ্বাস হলে যেমন হয়, অনেকটা তেমনি।
সকালে ঘুম ভাঙলো তাড়াতাড়িই। প্যাক করার তেমন কিছু নেই। ব্রেকফাস্টে সময় দিলে ঘোরা হবে না। পাঁচ মিনিটে যতোটা সম্ভব নাকে-মুখে গুঁজেই বেরিয়ে পড়ি। ড্রাইভারের নাম রিচার্ড। প্রৌঢ় ভদ্রলোক। একটু ভয় করছিল। যদি সোয়া ন’টার মধ্যে হোটেলে ফিরতে না পারি, তাহলে কী হবে, কে জানে। ফ্লাইট হয়তো আমাকে রেখেই উড়বে আকাশে। রিচার্ড ইংরেজি জানে না। তাও হাবভাবে এটা বুঝিয়ে দিয়েছি, কখন ফিরতে চাই। না হলে কী হতে পারে, এসব।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। প্রথম গন্তব্য মন্টে ব্রাজিল। টের্সেইরা দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলে। জায়গাটা উপদ্বীপের মতো। দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় সেখানে। রিচার্ডের মতে, ট্যুরিস্টদের এক নম্বর আকর্ষণ। চারপাশে চারটি ছোট পাহাড়। মাঝে অনেক পুরনো দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। পাহাড়ের উপর থেকে পাওয়া যায় আংরা শহরের বার্ডস আই ভিউ। কোন দিকে তাকাবো? একদিকে শহর আর তিন দিকে আটলান্টিক। অভূতপূর্ব দৃশ্য। মুহূর্তেই ভুলে গেলাম, আমি এখানে কীভাবে? রিচার্ড এ পথে প্রতিদিন যায়। ও হয়তো ভাবছে, এখানে দেখার কী এমন আছে? পাহাড়ে ওঠা আর নামার সময় ক’বার যে গাড়ি থামিয়ে দূরে তাকিয়ে থেকেছি, হিসাব নেই। লোকটা ভালো, এক বিন্দু বিরক্তি নেই চোখে।
নেপোলিয়নের সময় যুদ্ধবন্দীদের অনেককে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল আংরায়। ১৮৩০ সালে পাঠানো হয়েছিল পর্তুগালের রানী দ্বিতীয় মারিয়মকেও। আংরা শব্দের অর্থ গিরিখাত। আর হিরোইসমো এসেছে হিরোইজম থেকে। পর্তুগালে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আংরার মানুষের বীরত্বের স্বীকৃতিতেই দ্বিতীয় মারিয়া শহরের নামের সঙ্গে হিরোইসমো জুড়ে দেন।
রিচার্ড গাড়িতে ডেকে নেয় আমাকে। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়, তোমার সময় কম। আরও কিছু জায়গা ঘুরে দেখা যাক। সেখান থেকে আমরা আসি শহরের কেন্দ্রভাগে রু দ্য সে, মানে ক্যাথিড্রাল স্ট্রিট। এই স্ট্রিটেই ক্যাথিড্রাল অব দ্য হোলি সেভিয়্যর। পুরো আজোর্সের বৃহত্তম উপাসনালয়। এই গির্জাটি ছিল উত্তরমুখী। তখনকার ঐতিহ্য ছিল গির্জা হবে পূর্বমুখী- সূর্যোদয়ের দিকে বা জেরুজালেমের দিকে। জায়গার স্বল্পতা আর ঘনবসতির কারণে সেভিয়্যর গির্জা উত্তরমুখী হয়। ষোলো শতকে এর কাজ শুরু হয়।
সাদার সঙ্গে ঘিয়ে-হলুদ রঙের বহির্ভাগ। আকারে ছোট দ্বীপের অনুপাতে বেশ বড়। ভেতরের নকশা ঐতিহ্যবাহী। মিনার দুটিতে যুক্ত ভাস্কর্যে মিলন ঘটেছে ঐতিহ্য আর সমকালীন শিল্পকলার। পুরনো আর নতুনের অপূর্ব মেলবন্ধন।
দ্বীপটি ছোট হলেও নাগরিক সংস্কৃতির অাঁচ পাওয়া যায়। যেন মেইনল্যান্ড ইউরোপের কোনো এক শহরতলি। পাথরবিছানো সব পথ। গাড়ি চলে, তবে সাইক্লিংয়ের জন্য আদর্শ। এমনকি উঁচু-নিচু হওয়ার পরও। সূর্য উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেস্তোরাঁগুলো জমে উঠছে। পথের পাশে চেয়ার বিছিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন বয়সী কয়েকজন। স্বাস্হ্যসচেতন অনেকেই। দেখলাম, দল বেঁধে দৌড়াচ্ছে এক ঝাঁক তরুণ। এর মাঝেও রয়েছে কিছু অলস দেহ। এদের কিছু করার নেই।
আমরা মেরিনার দিকে যাই। পনেরো শতক থেকেই পশ্চিমা জাহাজের জন্য আংরা মেরিনা ছিল গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট অব কল। এখান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, জ্বালানি সংগ্রহ করা হতো। আজকালকার জাহাজে ট্রান্স-আটলান্টিক ভ্রমণেও পোর্ট অব কল লাগে না। ফলে, বন্দরের গুরুত্ব কমেছে কিছুটা। তবে অর্ধগোলাকৃতি বাঁধ দেয়া মেরিনা সত্যিই এক দর্শনীয় বন্দর।
মেরিনার উল্টো দিকে সৈকত। সকালে কোনো পর্যটককে দেখলাম না। এই বিচে ড্রাইভ করলে নাকি এখনো উনিশ শতকে ডুবে যাওয়া পর্তুগিজ জাহাজ লিদাদোরের ধ্বংসাবশেষ মেলে। এখন অবশ্য বন্দরের চেয়ে পোতাশ্রয় হিসেবেই বেশি খ্যাতি এই মেরিনার। দারুণ সব ইয়ট বাঁধা আছে সেখানে।
ক্যাথিড্রাল স্ট্রিটে এসে নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। হাঁটলাম কিছুক্ষণ। রিচার্ডও এসে যোগ দিলো। একেকটা ছোট-বড় গির্জা দেখিয়ে সেগুলো সম্পর্কে আমাকে ভাঙা ইংরেজিতে বোঝানোর চেষ্টা করলো।
আবার বৃষ্টি। এবার তুমুল। গাড়িতে আশ্রয় নিই। আংরাকে বলা হয়ে থাকে নতুন পৃথিবীর প্রথম শহর। আটলান্টিকের প্রথম ইউরোপীয় শহর। স্হাপত্য আর ইতিহাসের নানান চিহ্ন থাকায় ১৯৮৩ সালে আংরার ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়। ইউনেসকো জায়গা চিনতে ভুল করেনি। ইউরোপিয়ান স্হাপত্য, চিত্রকলা, বাণিজ্য আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি- আংরা দো হিরোইসমো।
কখন সময় গড়িয়ে গেল, টের পাইনি। হঠাৎ দেখি নয়টা। রিচার্ডকে বলি, হোটেলে চলো। যতো দ্রুত সম্ভব। মিনিট দশেক লাগে। পৌঁছে দেখি, সবাই বাসে। একজন রোল কল করছেন। মনোমুগ্ধকর এক ঝাঁপি স্মৃতি নিয়ে মিশে যাই সার্ভাইভারদের আন্তর্দেশীয় দলে।
- লেখক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
- ছবি: লেখক