মো হা ম্ম দ এ হ তে শা মু ল হক
শবনমে ফেরা
ইতিহাস আর সৌন্দর্য জড়াজড়ি করে আছে কাবুলে। সাহিত্য যেমন তা এড়াতে পারেনি, তেমনি কাবুলিওয়ালার জন্মভূমি, শবনমের স্মৃতিস্থল, এর তুষারশুভ্র পর্বতে রৌদ্রের ছটা থেকে চোখ ফেরাতে পারেননি মোহাম্মদ এহতেশামুল হক
রহমত আর শবনম। কাবুলে পা রাখার পর থেকেই দু’জনকে খুঁজছি। ক্লাসিকের চরিত্র। এঁদের কি আর জনারণ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে? উৎসুক মন যুক্তির ধার কবে ধেরেছে? একবারও মনে হয়নি, বিশের দশকে লেখা ফিকশনের চরিত্র তাঁরা। রহমত কাবুলিওয়ালা বেঁচে থাকলে বয়স হতো ১৭৫!
আর শবনম!
সন্ধ্যায় ভূরিভোজ সেরে আচমকা যেন শুনছি, গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন ‘তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র’সমা তরুণী। এসে হাঁক দিলেন, ‘সর্দার আওরঙ্গজেব খানের মোটর এদিকে ডাক তো!’ আমি থতমত খেয়ে কিছু বলতে যাওয়ার পর বিদেশি বুঝতে পেরে প্রথমটায় ফরাসিতে বলল, জ্য ভুঁ দঁমাদ্ পারদোঁ, মঁসিয়ো’ মাফ করবেন।
সংবিৎ ফেরে এর পরই। ১৯২২ নয়, এখন ২০১৪। আর আমিও সৈয়দ মুজতবা আলী নই। ছাপোষা উপদেশক! আর আমানুল্লার শাসনও নয় এখন। আজকের কাবুলে সাঁঝের আলো-আঁধারিতে হেঁটে ঘরে ফেরার সুযোগ নেই। কোনো বিদেশির জন্য তো নয়ই।
বিশ্বব্যাংকের উমেদারি নিয়ে কাবুলে এসেছি মধ্য ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায়। আফগানিস্তানে যখন-তখন বোমা হামলা, আত্মঘাতীরা তৎপর। বলতে গেলে পরিবারের প্রায় সবার অমতে পাড়ি জমাই। মূলত আফগান শুল্ক বিভাগের আধুনিকায়নে কাজ করার সুযোগ। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আর মুজতবা আলীর লেখনীতে চেনা আফগান জনমানুষের সঙ্গে মেশা। সিল্ক রুট ধরে ঘুরে বেড়ানো। চেঙ্গিস খান-হালাকু খানদের ধ্বংসাবশেষ দেখা। মালালা ইউসুফজাইদের ঘর-গেরস্থালির খবর নেয়া। আর দৃষ্টিসীমায় পাগমান পর্বতকে রেখে অল্পবিস্তর লেখালেখি। এই লোভেই আসা।
প্রথম ধাক্কা খেলাম জাতিসংঘের নিরাপত্তা দপ্তরে। হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে বলা হলো, এই তোমার আফগানিস্তান। এই তালিকায় দশ-বারোটি জায়গার বাইরে যাওয়ার অনুমোদন নেই। কতিপয় দূতাবাস, জাতিসংঘ-বিশ্বব্যাংকের দপ্তর আর মন্ত্রণালয়।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই হতাশা উধাও। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। কিন্তু ঝকঝকে রোদ। সঙ্গে ব্রিটিশ আর ভারতীয় উপদেশক। তিনে মিলে চললাম শুল্ক বিভাগের দিকে।
জালালাবাদ সড়ক ধরে মিনিট সাতেকের পথ। পথের সব দিকেই পর্বতসারি। পশ্চিমে হিন্দুকুশ। বামে কাবুল নদী। তার ওপারে পর্বতশ্রেণী। অন্য দু’পাশেও নাম না জানা পর্বতের সারি। কী যে তার শোভা!
এই পথ দিয়ে প্রতিদিন সকালে দপ্তরে যাই, বিকেলে ফিরি। একেক দিন একেক রূপ। একেক সৌন্দর্য। দুপুরের খরতাপে একরকম, বিকেলের হলুদ নরম আলোয় অন্য। তুষারপাতের পর কয়েক দিন টানা ধবলগিরি। আবার যখন চলে মেঘের সঙ্গে সূর্যের লুকোচুরি, পর্বতশীর্ষের রূপ যায় বদলে! কোথাও ফালি ফালি মেঘের আচ্ছাদন, আবার টর্চের আলোর মতো কোথাও ঔজ্জ্বল্য। কী অপূর্ব তার রূপ! তিন মাসেও পুরোটা দেখে উঠতে পারিনি।
শীতকালটা বেশ ঠান্ডা। ভোরের দিকে হিমাংকের কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে যায় পারদ। আমাদের অনভ্যস্ত ক্রান্তীয় চোখে সেও নান্দনিক। এ বছর তুষারপাত হলো বার আষ্টেক। প্রতিবারই তিন-চার দিন চারপাশ ঢাকা থাকে শুভ্রতায়। রোদের কমতি হয় না ওসব দিনেও। চারপাশ পর্বতে ঘেরা বলে খুব একটা কাবু করতে পারে না বাতাস।
দাপ্তরিক সফরে যেতে হবে জালালাবাদ। ভারতীয় সহকর্মী তা জানালেন এক সকালে। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিয়ে রাখলাম আগেই। নিছক কৌতূহলবশেই অন্তর্জালে চোখ রাখলাম। বলা হচ্ছে, কাবুল-জালালাবাদ সড়ক হলো বিশ্বের ভয়ংকরতম। প্রমাদ গুনি। নিরাপত্তা দপ্তরের ফোন, খুব প্রয়োজন না হলে আমরা যেন যাত্রা বাতিল করি। পথে খুব গোলমাল হচ্ছে। আত্মঘাতীরা বোমা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে জালালাবাদ শহরে। আর মহাসড়কের দু’পাশ থেকে গুলির ঘটনা ঘটছে হরদম। তার ওপর, সরু এ সড়কের চালকরা বেপরোয়া। পাকিস্তান থেকে আসা লরিগুলোকে পাশ কাটাতে গিয়ে দুর্ঘটনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব শুনে আমি একটু দমে যাই। কিন্তু রবি গন্টা নাছোড়বান্দা। ও যাবেই যাবে।
অবশেষে ঠিক হলো, যাচ্ছি আমরা। সামনে-পেছনে নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি। মাঝে আমাদের দু’টি বুলেটপ্রুফ ভি-সিক্স। ভয়ে ভয়েই রওনা জালালাবাদের উদ্দেশে। সব ভয়ংকরই সুন্দর! বেঙ্গল টাইগারের সর্বগ্রাসী ও রাজসিক মুখভঙ্গির মতো। দু’পাশের শোভা দেখতে দেখতে ভয় উধাও।
কাবুলের গন্ডি ছাড়ানোর আগে রাস্তার দু’পাশ বেশ জমজমাট। ছোট ছোট ক্যারাভানে কেনাবেচা চলছে সবজি, ফল, কার্পেট আর টায়ারের। কয়েকটা মেয়ে বিক্রি করছে ওড়না আর বোরকা। ওড়নার দোকানটায় যেন রঙের খেলা। এরা উজ্জ্বল রঙ বেশি পছন্দ করে, আগেও খেয়াল করেছি।
আগে থেকে বলা ছিল, পথে কোথাও থামতে পারবো না আমরা। কে শোনে কার কথা! শুল্ক বিভাগের বড় কর্তা গাড়ি থামিয়ে সবার জন্য কিনলেন কমলা, ডালিম আর আপেল। বেশ মিষ্টি আর রসালো এ দেশের ফল। বাদাম আর আখরোটের তো জবাব নেই। বুঝলাম, কী দিয়ে রহমত কাবুলিওয়ালা মিনি খোঁকির মন জয় করেছিলেন!
কাবুল নদীর পাশ ঘেঁষে পাগমান পর্বতের মাঝ বরাবর চলেছে জালালাবাদের কনভয়। এই নদীই খানিক পরে পাড়ি জমাবে পাকিস্তানে। প্রতিদিনের দেখা পর্বতরাজি এখন অনেক কাছে, পাথরছোড়া দূরত্বে। এখানে ব্রেক নেয়ার সাহস কেউ দেখাননি। তুষারের গা চিরে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। আর ভাবছি, পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা ইতিহাস আর নিসর্গের এই লীলাভূমিতে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো পর্বতশীর্ষ থেকে ওয়াখান উপত্যকা, জালালাবাদ সড়ক থেকে মাজার-ই-শরিফ মহাসড়ক, সিল্ক রুট, হেরাতের নীল মসজিদ, তোরখাম তোরণ আর পূর্বের বনফুল, মানুষের উষ্ণ অভিবাদন, নিমেষে বন্ধুতার আবাহন কী নেই?
আফগানরা ভোজনরসিক। অনেকটা বেগম রোকেয়ার লেখা বাঙালি মুসলমানের রসনাবিলাসের মতো। খাবার আয়োজন জম্পেশ। আমিষ আর শর্করার আধিক্য। তবে পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই। দপ্তরের চাপরাশি ওয়াইজউদ্দিন চারটা প্লেটে হয়তো পরিবেশন করলো কাবুলি পোলাও, দই, শিমবিচি আর সালাদ। নানরুটিটা নির্লিপ্ত চোখে টেবিলে রেখেই উধাও। ঝোলে মাখা ওই রুটি আবার ওখানেই রাখতে হবে।
প্রথম ক’দিন ঘর থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। কিন্তু রোমে এলে রোমান চালেই তো চলা উত্তম। ওদের দলে যোগ দিলাম। মেইন ডিশ যা-ই থাকুক না কেন, সঙ্গে আধখানা নান থাকবেই। প্রথম দিন এলো কাবুলি পোলাও। ওদের ‘জাতীয় খাবার’। বাসমতী চালের পোলাও। সঙ্গে শুকনো গাজর। আরও কয়েক রকম ফলের টুকরো। সস দেয়ায় রঙটা বদলে হয়েছে বাদামি। বাদামি রঙ শুধু নয়, পেস্তা বাদামও আছে। আহ্! কী তার সোয়াদ। লিখে আর ভাগ দিতে পারবো না আপনাদের। কাবুলে এলে পেট পুরে খাওয়াবো।
পরদিন এলো নান আর শামি কাবাব। আরেক দিন কোরমা পোলাও। সঙ্গে আলুবোখারা। এরা দেখছি আমাকে হৃদ্যন্ত্রের রোগ না বাঁধিয়ে ছাড়ছে না।
সেদিন এলো চাপাতি আর গোশত। এ তো সেই খাবার। শনবম বানুর কসরত চোখে ভাসছে। হাতের পাঁচ আঙুলে পেঁচিয়ে জাদুকরী প্রতিভায় রুটিতে ঝোল তুলে আনা, এরপর মুখে পাচার। এক বিন্দু ঝোল লেগে নেই কোথাও। হাত ধোয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। শবনমের ভোজন-ভাবনায় নিজের খাবার জমে হিম।
ইউএন ভিলেজের আফগান রেস্তোরাঁয় গেলাম একদিন। সব শেষ। আছে শুধু ‘মান্তু’। অনেকটা মোমোর মতো। ভেতরে পেঁয়াজ-গোমাংসের কিমা। ওপরে টকদই আর টুকরো রসুন। সাইড ডিশ হিসেবে পনির আর রুটি। কাবাব আমাদের মতোই। শিক কাবাব, শামি কাবাব, ল্যাম্ব চপ, কোফতা আসে দু-এক দিন পর পরই। দুপুরে এসব খেয়ে রাতে খাওয়া বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছি।
যা হোক শবনমরা গৃহবন্দী এখনো! তালেবান শাসন অবসানের পর অগ্রসর সমাজের এক ঝাঁক নারী অবশ্য বেরিয়ে এসেছে আগল ছেড়ে। সেই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এদের দু’জন হাসিনা আর উইদা। দু’জনই সহকর্মী এখানে। হাসিনা প্রকৌশলী। সুন্নি। লাস্যময়ী। ভালো ইংরেজি বলেন। আর উইদা ব্যবস্থাপনায় স্নাতক। পেশোয়ারের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ফিরেছেন। বিয়ে করেননি দু’জনার কেউই।
অভিজাত ঘরের মেয়ে এরা। নিম্নবিত্তের পক্ষে এতটুকু আসা কেবল দুঃসাধ্য নয়, রীতিমতো অসাধ্য। কথায় কথায় একদিন বলেই ফেললাম, তাহলে মালালা? দু’জনেই একবাক্যে বলে ওঠেন পশ্চিমা মিডিয়ার বানানো গল্প।
উইদা কাবুলের মেয়ে। ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। তালেবান শাসনের সময় সবার সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছেন পেশোয়ারে। হামিদ কারজাই ক্ষমতা নেয়ারও বেশ কিছুদিন পর দেশে ফেরেন। এশিয়া ফাউন্ডেশন, জাতিসংঘের হয়ে কাজ করার পর এখানে নোঙর। মাথায় ওড়না থাকলেও অন্যান্য পোশাকে পশ্চিমা প্রভাব। বলেন, ‘দেশের বর্তমান দেখে আমাদের বিচার করো না। শুনেছি, আমার দাদি স্কার্ট পরতেন!’ হো হো করে হেসে ওঠেন সবাই।
হাসিনা হেরাতের মেয়ে। আধুনিকা পোশাকে। তবে উগ্র নয়। নিজে ড্রাইভ করেন কাবুলময়। বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। তবে উইদার মতো কথার তুবড়ি ফোটান না। কী একটা কথায় মুচকি হাসেন। মুখে টোল। খুব চেনা চেনা লাগছে! এ কী! এ শবনম শিউলি নয় তো!
- মোহাম্মদ এহতেশামুল হক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
- ছবি: লেখক