মো হা ম্ম দ এ হ তে শা মু ল হ ক
হ্রদ-পর্বতের যুগলবন্দী
হ্রদপ্রান্তে ছোট্ট শহর তে আনাও। ভ্রমণপিপাসুদের নিয়মিত গন্তব্য নয়। কুইন্সটাউন থেকে মিলফোর্ড সাউন্ড যাওয়ার ট্যুর বাস ক্ষণিকের বিরতি নেয় এখানে, ফেরার পথে লাঞ্চ ব্রেক। কিন্তু ক্লান্তি হটাতে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা তো না শুনলেই নয়। বলছেন মোহাম্মদ এহতেশামুল হক...
প্ল্যান ছিল অন্য রকম। সঙ্গে স্ত্রী-কন্যা। ওদের যেন ক্লান্তি গ্রাস না করে। তে আনাওতে তাই ক্ষণিকের নয়, রাত্রিবাস করবো ঠিক করলাম।
সিদ্ধান্তটা যে অমূল্য ছিল, বুঝতে সময় লাগেনি। এমনিতে পর্যটকের ভিড় আর কোলাহল থেকে দূরে এ ধরনের জায়গা আমার ভীষণ পছন্দের। সেখানে ভালো হোটেলও মেলে সস্তায়। মেলবোর্ন বা অকল্যান্ডে যে পয়সায় তিন তারকা হোটেলের ছোট্ট ডাবল বেডরুম মেলে, সমান পয়সায় এখানে ভিলা পেলাম। ছোট্ট বিভোর খুব খুশি। গুটি গুটি পায়ে এঘর-ওঘর করছে।
ক্রাইস্টচার্ট থেকে কুইন্সটাউন। দেড় ঘণ্টার ফ্লাইট। ট্রাভেল এজেন্ট বলছিল, বাস নিতে পারো। ক্যান্টারবারি সমতল, ম্যাকেঞ্জি কান্ট্রি ছাড়িয়ে তেকাপো হ্রদ। লাঞ্চ করবে হ্রদের ধারে। পরে লিন্ডিস পাস, কাওয়ারাও গজ ছাড়িয়ে বিকেলে কুইন্সল্যান্ড। পুরো পথে সবুজ-নীলের গলাগলি, পাহাড়-বনানী-হ্রদ। এমন নৈসর্গিক শোভা ভোলার নয়। আট ঘণ্টার পথ।
একা থাকলে একবাক্যে রাজি হতাম। সঙ্গে বিভোর আর রূপা। অ্যাডভেঞ্চারের পথে না গিয়ে সকালের ফ্লাইট নিলাম। তুষারের টুপি পরে শফারের মতো যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে সারিবদ্ধ পাহাড়। ল্যান্ডিংয়ের ঘোষণা আসতেই নিচে তাকিয়ে দেখি বিশাল হ্রদ। ওয়াকাটিপু।
এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে ওয়াকাটিপুর নীল পানি রেখে মাঝ বরাবর যেভাবে ল্যান্ড করছিল জেটস্টারের উড়ালযান, তা ছিল অনবদ্য।
নিউজিল্যান্ড হ্রদের দেশ। তাওপো, তে আনাও, ওয়াকাটিপু, ওয়ানাকা, ওয়াঙ্গা লেগুন, পুকাকি, মানাপুরি দারুণ সব নাম। মাওরি ভাষা থেকে নেয়া। নামকরণে ব্রিটিশদের পথে না গিয়ে আদিবাসীদের ভাষাই বেছে নিচ্ছে তারা। দশ বর্গ কিলোমিটারের বেশি এমন হ্রদই আছে একচল্লিশটি। তে আনাও দ্বিতীয় বৃহত্তম। ওয়াকাটিপু তৃতীয়।
ঘণ্টা খানেক বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। হ্রদের পাশ ঘেঁষে পথ। বিভোর স্টলারে। আমি আর রূপা পাশাপাশি হাঁটছি। লেক থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। কৃত্রিম কোনো শব্দ নেই। মনে হচ্ছিল, যেন অনন্তকাল হেঁটে চলেছি, ক্লান্তিহীন। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, কেমন হতো, তুমি বলো তো!’
দু’ঘণ্টা কাটালাম লেকের পাশে। ঘড়ির কাঁটায় নজর ছিল না। ক্ষুধা জানান দিল, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। হ্রদের পাশে ছোট্ট শহরও গড়ে উঠেছে। পুরোভাগে কয়েকটি পেট্রোল স্টেশন আর রেস্তোরাঁ। এত দূরে এসেও ট্র্যাডিশনাল ভারতীয় রেস্তোরাঁ পেয়ে যাব, ভাবিনি। মানুষজন নেই। বিরিয়ানি তৈরি হলো আমাদের জন্য। খাবার পরিবেশন করছিল যে মেয়েটি, ওর নাম শকুন্তলা। কোলকাতার। ছোটবেলা থেকেই এখানে থাকে। ওদের পারিবারিক ব্যবসা এই রেস্তোরাঁ। মেয়েটি মেডিকেলে পড়ে, ডুনেডিনে। ছুটি পেলে বাবা-মায়ের কাজে সাহায্য করতে এখানে চলে আসে। ভরপেট খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে ছিলাম হ্রদের পাশে। দূরে পাহাড়ের সারি।
পরদিন সকালেই মিলফোর্ড সাউন্ডের পথে যাত্রা। মানাপুরিতে আনাও লেক থেকেই দক্ষিণে সূচিত ফিয়র্ডল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে প্রায় বারো হাজার বর্গ কিলোমিটার নিয়ে সাদার্ন আল্পসের হ্রদ উপত্যকাময় ভূস্বর্গ। চারপাশে ঘনশ্যাম পাহাড়, মাঝে হ্রদ এই আকর্ষণীয় বিন্যাসকেই বলে ফিয়র্ড বা সাউন্ড। এদের মধ্যে মিলফোর্ড সাউন্ড সবচেয়ে বিখ্যাত।
তে আনাও থেকে ভোরেই রওনা হলাম মিলফোর্ডের উদ্দেশে, মানে, ফিয়র্ডল্যান্ড চিরে পাওয়া পিচঢালা পথ পেরোনোর পালা। অনেকক্ষণ পর পর নৈঃশব্দ্যের লয় কাটে ট্যুর বাসের শব্দ। তিন ঘণ্টার এ পথ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিশ্বসেরা বলে ট্রাভেলার্স ডয়েস স্বীকৃতি পেয়েছে।
দু’পাশেই সাদার্ন আল্পসের বিস্তার; কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। উপরের দিকটা তুষারে ঢাকা, নিচে সবুজ-হলুদ গাছগাছালি আর লতাগুল্ম। কান পাতলে শোনা যায় কখনো পাখির কিচিরমিচির, কখনো নির্ঝরিণীর মূর্ছনা।
ট্যুর বাসের ড্রাইভার নিজেই গাইড। কমেন্ট্রি দিয়ে চলেছেন একটানা। কিছুক্ষণ পর পর ব্রেক। বিশেষ সব স্পট, সেখানে মিনিট দশ-পনেরো ঘুরে দেখার সুযোগ, সঙ্গে ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। আধঘণ্টা পর প্রথম স্পট-এগলিন্টন উপত্যকা। শীতকালে নদী বেয়ে হিমবাহ আসে। এখন গ্রীষ্ম। নদীর দু’পাশে সবুজের সমারোহ। কোথাও কোথাও নাম না জানা বেগুনি আর সাদা ফুল।
কিছুদূর গেলেই আয়না হ্রদ (মিরর লেক)। শান্ত জলাধারের অন্য পাশে তুষারধবল পর্বত। পানিতে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। তাকালে মনে হয়, বেদনাহত পাহাড় উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে। এরপর অ্যাভিনিউ অব ডিজ-অ্যাপিয়ারিং মাউন্টেন। এখানে দৃষ্টিবিভ্রম হয়। দূরের পাহাড়রাজিকে ক্ষুদ্র নয়, বরং বৃহৎ মনে হতে থাকে। মিলফোর্ড যখন খুব দূরে নয়, পেলাম গ্রানাইট পাথরের সুড়ঙ্গ হোমার টানেল। পাথর কেটে ১২৭০ মিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরিতে সময় লেগেছে পুরো বিশ বছর।
অবশেষে পৌঁছাই মিলফোর্ড সাউন্ড, মাওরি ভাষায় পিওপিওতাহি। মাওরি রূপকথার পাখি পিওপিও। মানুষের অমর রাজ্যের চেষ্টা করতে করতে যখন প্রাণ হারালো মাওয়ি, শোকের সুর শুনিয়ে এখানে আসে পিওপিও পাখি।
অসংখ্য ট্র্যাভেল ম্যাগাজিন আর ওয়েবসাইট বলছে, মিলফোর্ড সাউন্ড বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট, নিউজিল্যান্ডের তো বটেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র। এখানে স্বচ্ছ জলাধার। সমুদ্র কিংবা উপসাগর বলা চলে। সাদার্ন আল্পসের খাঁজে খাঁজে ঢুকে পড়া তাসমান সাগর। ডেল পয়েন্ট থেকে পনেরো কিলোমিটার ভেতরে। পুরো এলাকায় ছড়ানো শিলাময় পর্বত। মোহনার দিকটা ঘিরে রেখেছে চার হাজার ফুট উঁচু কয়েকটি অতিকায় শিলাখন্ড। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দ্য এলিফ্যান্ট (৪৯৭৭ ফুট), দেখতে হাতির মাথার মতো। অন্য পাশে দ্য লায়ন, কোমর ফোলানো সিংহ যেন।
জলভূমিতে ক্রুজশিপে বেড়ানোই মূল আকর্ষণ এখানে। মাঝারি আকারের সাদা জাহাজের টিকিট নিলাম। ইঞ্জিনের শব্দে খান খান নীরবতা। কখনো মাঝ বরাবর, আবার কখনো শিলাখ- ঘেঁষে চলছে আমাদের জাহাজ। একটু পর ছাদে চলে এলাম। বরফশীতল বাতাস। বিভোরকে সোয়েটার আর কানটুপিতে ভালো করে ঢেকে নিলাম। এরপরে তিনজনই বিভোর অভাবনীয় নিসর্গ দেখে। একটু পর পর জলপ্রপাত, পর্বতশীর্ষ থেকে। ভারী বৃষ্টির পর এমন জলপ্রপাত কয়েক শ ছাড়িয়ে যায়। সংবৎসর চলে লেডি বাওয়েন ফলস আর স্টার্লিং ফলস। ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যায় না। আর প্রকৃতির এমন আন্তরিক হাতছানি, ভেতরে বসেও থাকা যায় না। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করছিলাম।
আচমকা পাশে দেখি ডলফিনের ডাইভ। একটি। এরপর আরও কয়েকটি। যেন পোষা ডলফিন খেলা দেখাচ্ছে। জানলাম, সিল চোখে পড়ে প্রায়ই। কখনো কখনো তিমিও।
ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের অনেক আগেই মাওরিদের বসবাস ছিল ফিয়র্ডল্যান্ডে। এখানকার জোয়ার-ভাটা বিষয়ে তারা ছিল ওয়াকিবহাল। ফিওর্ডের বুনো জীবজন্তু, পাখি আর মাছেদের সঙ্গে মহাসুখে ছিল তারা। শোনা যায়, বেশ আয়োজন করে মাছে খাবার দিত মাওরিরা। প্রকৃতিতেই তারা লীন ছিল।
বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত ছিল অনাবিষ্কৃৃত মিলফোর্ড। খাড়া পর্বতের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নাকি পশ্চিমারা এদিকটায় আগ্রহী হয়নি। শুধু এ জন্যই জেমস কুক তাসমান সাগর পাড়ি দিলেও ফিয়র্ডের দিকে এগোননি। পরে জন গ্রনো নামের এক অভিযাত্রী ওয়েলসের মিলফোর্ড অবলম্বনে এই জল আর শিলার বিন্যাসের নতুন অভিধা দিয়েছেন মিলফোর্ড সাউন্ড। সেই শুরু। এর পর থেকেই দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনায় জমে ওঠে জায়গাটি। রুডইয়ার্ড কিপলিং তো একধাপ এগিয়ে একে পরিচয় করিয়ে দেন পৃথিবীর ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলে।
মিলফোর্ড থেকে আমরা আর তে আনাও ফিরে যাইনি, একেবারে সরাসরি কুইন্সল্যান্ড। ওয়াকাটিপু হ্রদের পাশের হোটেল শেরউড পাইন লজে উঠলাম। যখন পৌঁছেছি, রীতিমতো রাত নেমেছে। পরদিন কুইন্সটাউন-অ্যারোটাউন সন্দর্শন। কুইন্সটাউনকে বলে অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড। স্কাই ডাইভ, বাঙ্গি জাম্প, প্যারাগ্লাইডিং, কী নেই? শীতকালে সঙ্গে যোগ হয় স্কিয়িং, স্নো বোর্ডিং আর জেট বোটিং। কুইন্সটাউনে এলে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর খোঁজই থাকে না।
অ্যাডভেঞ্চারের আমরা শুধু দর্শক। ভয়ংকর এসব খেলায় মেতে ওঠার সাহস পাইনি। দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেকক্ষণ, অভিযাত্রীদের উল্লাস আর চিৎকার। ফুল অব লাইফ।
ওয়াকাটিপু হ্রদ এখানকার মূল আকর্ষণ। ফ্রাংকটন রোডের এক পাশে আমাদের হোটেল, অন্য পাশে হ্রদ। হ্রদের তীরে লাল-হলুদ নানা বর্ণের ফুল আর পাতার বাহার। লর্ড অব দ্য রিংস ট্রিলজিতে বেশ ক’বার দেখা গেছে এই হ্রদের চিত্র।
প্রথমেই গন্ডোলা রাইড (কেবল কার)। এত্তো খাড়া! ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। রূপার অবস্থানও তথৈবচ। শুধু বিভোরই শঙ্কাহীন। মাঝে মাঝে ফিক ফিক করে হাসছে। নিচের স্টেশন থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তুলে ফেললো ৪৫০ মিটার ওপারে, বব’স পিক-এ। একটু পর ভয় কাটতেই বিস্ময় নিয়ে তাকাতে থাকি চারদিক। ২২০ ডিগ্রির প্যানোরমিক ভিউ। পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য চোখের সামনে!
মুখ দিয়ে অবচেতনে বেরিয়ে আসে, আহ্, এখানেই যদি থেকে যেতে পারতাম বাকি জীবন!
- মোহাম্মদ এহতেশামুল হক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
- ছবি: লেখক