ছবি: সংগ্রহ |
দে ব লি না
এবং সেই একটা দিন
বড় রাস্তার থেকে অল্প আলো এসে পড়ছে এই গলিটার বুকে। শুনশান, অন্ধকারে হয়তো কিছু মানুষের ছায়া কল্পনা করা যায় বেশ। কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠলো। বেশ শান্ত এই সময়টা । পাশের কারখানার সারাদিনের আওয়াজ টা কমে এসেছে। সারাদিনে কয়েকটা ফেরিওয়ালা ঢুকলেও রাত্তিরে কেউ ঢোকে না। একা পড়ে থাকে গলিটা, ব্যাস্ত শহরের বুকে।
আমি অনিতা। নামটা এক্কেবারেই বেমানান, মিশমিশে কালো গায়ের রঙ, খুব বেঁটে আমি। বাবা, মা আর আমি থাকি দোতলার এই ছোট্ট ঘরটায়। বাবা একটা দোকানে কাজ করে, ততটা পয়সা পায়না, তাই এই ঘরটা আর আমরা তিনজন ই আমাদের সম্বল। খাটের পাশে মা রান্না করে, আমি পড়ি বিছানায় বসে। বাবা চৌকাঠে বসে একটু জিড়িয়ে নেয় সারাদিনের খাটা খাটুনির পরে। রোজ সকালে স্কুলে যাই, এসে মায়ের সেলাইয়ে একটু সাহায্য করি। বেশ ভালো ছিলাম আমি। অভ্যস্ত ছিলাম নিজের জীবনে। বাবা মায়ের বোঝা আমি, এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়নি এতটুকুও। আসলে এরকম মেয়েকে এই শহরে কোন ভালো ছেলে বিয়ে তো দুরের কথা , মুখ ফিরিয়ে কথাও বলেনা। না বলুক, আমার চাইনা ওসব। আমার এই সন্ধ্যে বেলার একা জানালা, অন্ধকার গলি আর সেই অন্ধকারে কল্পনা করে নেই অনেক মানুষের মুখ-ওরাই কথা বলে আমার সাথে। আমি সারাদিনের সব কথা ওদের বলি। ও হ্যাঁ ! একটা পুতুল আছে ছোটবেলার, ওকেও বলি ।
দিনটা কি ছিল ? যেদিন তুমি প্রথম ফোন করলে ? কিনাম বললে তোমার ? দেবদ্বীপ ?
জানো আমি দেবের ভীষণ বড় ফ্যান। আমার খুব ভালো লাগে ওকে। আমি পুরো পাগল ওর জন্যে। কি হয়েছিল জানো, তুমি যেদিন ফোন করলে তার আগের দিন রাত্রে আমি দেব কে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। আমি না কেমন একটা হয়ে গেলাম তোমার নাম শুনে। একটা ১৪ বছরের মেয়ে , আবেগে ভেসে গেলো। তুমি বললে আমার মামার ছেলের কাছ থেকে নম্বর নিয়েছো। বন্ধু হতে চাও। আমিও রাজি হলাম। অনেক কথা বলতাম আমরা। তবু ভয় ছিল যদি আমায় দেখে তুমি আর কথা না বলো। তোমায় বললাম। কেমন করে জানিনা কয়েকদিন পরে তুমি বললে আমায় ভালোবাসো। আমি বুঝতে পারছিলামনা একটা ছেলে এতো তাড়াতাড়ি কেন এমন বলছে। আমায় চেনে না জানে না। তবু, তোমার কথা আমি দূরে ঠেলে ফেলে দিতে পারিনি। তুমি খুব ভালো কথা বলো। পারিনি তোমায় দূরে সরিয়ে রাখতে আবার চাইনি তোমায় ঠকাতে।
আমি রুপকথার রাজকন্যে নই দেবদ্বীপ। মা কে বললাম কেন জানিনা মা বললো তোমাকে আসতে আমাদের বাড়ি। তুমি এলে, আমার মামার ছেলের সাথে। তোমায় কি সুন্দর দেখতে গো ? আমি ভাবতেই পারিনি এরকম একটা ছেলে আমার সাথে কথা বলবে, আমায় ভালবাসবে। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম মাকে জড়িয়ে ধরে। বলেছিলাম মা ওর তো আমাকে পছন্দ হবেনা , আমি কি করবো। তুমি থাকলে অনেক্ষুন, গল্প করলে, মা ঘুগনি বানিয়েছিল, তুমি খেলে। বেরোবার সময় আমাকে ইশারায় কেন বললে আমায় তোমার পছন্দ হয়েছে? জাননা আমি কি খুশি ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো, মানে আমি বোঝাতে পারবো না আমি পাগল হয়ে গেছিলাম দেবদ্বীপ ।
মা কে বলছি বাবা কে বলছি, খোলা জানলা কে বলছি, অন্ধকার গলি কে বলছি। আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার এই রূপ হীন মানুষটার মন শুধু তোমাকে দিলাম।
তুমি আবার এলে, ভ্যালেনন্টাইন্স ডে'র দিন। কথা বললে, অনেক গল্প করলে। মা তোমায় খুব বিশ্বাস করে ফেলেছিল। সেদিন রাত্রে মা তোমাকে ফোন করে বলেছিল, তুমি আমাদের অবস্থা জানো। কিছুই লুকোয়নি আমার মেয়ে। তুমি যদি ওকে ওর মত করে মেনে নিতে পারো তবে এগিয়ো। আমাদের এই একটি মাত্র মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি আমার ছেলের মত....
তুমি বললে তুমি সব জেনে বুঝেই এগিয়েছো। ভালোবাসো আমায়।
সেদিন , শনিবার, আমি স্কুল থেকে ফিরে তোমায় ফোন করলাম। ধরলে না। রাত্রে ফোন করলাম, অনেকবার ।তুমি ধরলেনা। আমার গলির অচেনা অন্ধকারে খুঁজে পেলাম না কাউকে যে তোমার খোঁজ দিতে পারে।
তখন অনেক রাত তুমি ফোন করলে। তুমি কি এইগুলোই বলেছিলে-" দেখো অনিতা তোমায় আমার কিছু বলার আছে, আমি তোমাকে ঠকাতে পারবোনা । সঞ্জয়, মানে তোমার মামার ছেলে আমার সাথে এক সাথে পড়ে। ও আমায় এসে বলেছিল একটা মেয়ে, খুব বাজে, ছেলেদের চড়ায়, তাকে কদিন ঘুরিয়ে নাচিয়ে ছেড়ে দিতে। এরপর আমাকে নানা
ভাবে রাজি করিয়ে ও তোমার সাথে ফোনে আলাপ করায়। আমি ওর কথা মতো সব করি কিন্তু তোমার বাড়িতে দুদিন গিয়ে বুঝতে পারি ও আমায় মিথ্যে বলেছে, তুমি খুব ভালো মেয়ে। আমি তোমাকে ভালোবাসি না। পারলে আমায় ক্ষমা কোরো। আমাদের আর কথা হবেনা।"
এসব কি ছিল দেবদ্বীপ ? আমি আমার একলা জানালায়, মাকে জড়িয়ে ধরে এই প্রশ্ন টাই করেছিলাম গলির অন্ধকারকে, এসব কি ছিল দেবদ্বীপ ?
মা ফোন করেছিল তোমায়, খুব কষ্ট পেয়েছিল, বলেছিল তোমায় যে তুমি কোনোদিন সুখি হতে পারবেনা। সবাই তোমাকে ছেড়ে যাবে। তুমি কষ্ট পেয়োনা। মা রেগে বলেছে।
গলির অন্ধকারটা আরও গাঢ় হয়ে গেছে, বড়রাস্তার আলো একটুও এসে পড়ছে না। আমি একটু বেশি ভাবে বাবা মায়ের বোঝা হয়ে গেছি। একটা বেঁটে, কুৎসিত দেখতে মেয়ের মন বলে কিছু থাকেনা। বিয়ের পিড়িতে, ভালোবাসার দোলনায় শুধু তার শরীর টাকে চাই, সেটা যত সুন্দর হবে, তত ভালো।
তুমি ভালো থেকো ।
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। তুমি আমার কাছে আবারও ক্ষমা চেয়েছিলে । প্রায় বছর দুয়েক বাদে। কিন্তু ক্ষমা করবো কাকে? তোমাকে না নিজেকে ?
- - -
দেবলিনা
বাংলা বিভাগ, বি.এ.
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।