আবু নাছের মঞ্জু, নোয়াখালী:
দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতাই এখন নোয়াখালীর প্রকৃতি ও জনজীবনের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ চার দশকেও জলের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি নোয়াখালীর মানুষ। খাল দখল ও ভরাট, প্রয়োজন মতো খাল খনন ও পরিষ্কার না করা, মাছ চাষের জন্য খালে বাধ তৈরি এবং পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা দিন দিন আরো প্রকট আকার ধারন করছে। জলাবদ্ধতার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। সেই সাথে পরিবেশ প্রতিবেশেরও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এবারও নোয়াখালীতে আমন মওসুমে সাড়ে ৪৩ হাজার হেক্টরেরও বেশি কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে থাকছে। যুগের পর যুগ ধরে একই অবস্থা বিরাজ করলেও এনিয়ে সঠিক কোন পরিকল্পনা না থাকায় জলাবদ্ধ এই জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনা যায়নি। অথচ; অনাবাদি এই জমিগুলোতে আমন চাষ করা গেলে আরো অন্তত সোয়ালাখ টনেরও বেশী ধান উৎপাদন করা যেত।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে; জলাবদ্ধ জমিগুলো অন্যান্য এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত নিচু। তাছাড়া বর্ষা মওসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য যেসব খাল রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেয়। রোপা আমন লাগানোর পুরোটা সময়ই আড়াই-তিনফুট পানির নিচে ডুবে থাকে জমিগুলো। ফলে কৃষকেরা বঞ্চিত হন চাষাবাদ থেকে। জেলায় ধানের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এই অনাবাদি জমিগুলোকে আবাদের আওতায় আনার বিকল্প নেই।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, জেলার মোট আবাদি জমির পরিমান হচ্ছে ২ লাখ ৪ হাজার ২০৪ হেক্টর। চলতি রোপাআমন মওসুমে চাষের লক্ষমাত্রা ছিল ১লাখ ৪৯হাজার ৭৯৬ হেক্টর। চাষ হয়েছে ১লাখ ৫৮হাজার ১৬৬ হেক্টর। একই সময়ে শাক-সজজি চাষ হয়েছে আরো প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে। বাকিজমি (৪৩ হাজার ৫৩৮ হেক্টর) জলাবদ্ধতার কারণে অনাবাদি। এরমধ্যে বেশী জমি অনাবাদি রয়েছে বেগমগঞ্জ উপজেলায় ১৫হাজার ৬৬২ হেক্টর। এরপরই রয়েছে সোনাইমুড়ীতে ১০হাজার ৬৫০ হেক্টর; চাটখিলে ৮হাজার ১৫০হেক্টর; সেনবাগে ৩হাজার ২৮৮হেক্টর; কবিরহাটে ২হাজার ৫০০হেক্টর; এবং সদর উপজেলায় ৩হাজার ২৯২হেক্টর জমি।
সরেজমিন জেলার সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জলাবদ্ধতার কারণে এসব উপজেলার অনেক কৃষক জমিতে রোপাআমন লাগাতে পারননি। এনিয়ে কৃষকদের মাঝে রয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। যুগের পর যুগ ধরে একই ভোগান্তি তাঁদের। সারা বছর একটি মাত্র (বোরো) ফসলের উপর নির্ভর করতে হয় তাঁদের।
বেগমগঞ্জের আলাইয়াপুর এলাকার কৃষক ছায়েদুল হক মিয়া জানান, ’রেডিও-টেলিভিশনে সরকার ক্যাল কৃষি আর কৃষকের উন্নতির কতা কইতে হুনি। আঙ্গো এই হানির সমস্যা দুর কইরলে যে ধান হাইতাম তাতে নিজেরগোও লাভ অইত; পাশাপাশি দেশেরও উকার অইতো।’
সোনাইমুড়ী উপজেলার নদনা এলাকার কৃষক আমির হোসেন জলাবদ্ধ বিশাল মাঠ দেখিয়ে বলেন, ‘এই মাডে আরও দুইকানি জমি আছে। হানিরলাই ধান লাগাইতাম হারি না। সরকার এই দিগে খেয়াল কইরলে আমরা কৃষকের অভাব অনেক দুর অই যাইতো।’
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, জলাবদ্ধতার কারনে পতিত পড়ে থাকা এই বিপুল পরিমান জমি কি উপায়ে আবাদের আওতায় আনা যায় তা নিয়ে তাঁরাও জোর চিন্তভাবনা করছেন। এই অবস্থায় বন্যা কবলিত এলাকার জন্য ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত বিরি ৫১ ও ৫২ জাতের ধানকে এই এলাকায় চাষ করা যায় কিনা তা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানান তিনি।
নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান জানান, জলাবদ্ধতা নিরসন ও সেচের সুবিধার্থে তাঁরা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলার খালগুলো খননের জন্য প্রকল্প তৈরী করে পানি উন্নয়ন বোর্ডে দাখিল করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
- আবু নাছের মঞ্জু