সর্বশেষ

রায়গঞ্জের শীতলপাটি শিল্প খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার নয়াদিগন্ত।। বছরে আসতে পারে প্রায় ১০ কোটি টাকা

মাহবুবুর রহমান,সিরাজগঞ্জ থেকে: 
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার দরবস্ত গ্রামের শীতলপাটি শিল্প খুলে দিতে পারে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিগন্ত। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ শিল্পটি হয়ে উঠতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির মূল শক্তি। আবহমানকাল থেকে রায়গঞ্জ উপজেলার মধ্যবিত্ত ও নিম্নধ্যবিত্ত মুসলিম হিন্দু পরিবারের মেয়ের বিয়েতে গহনা, থালা-বাসন, লেপ-তোষকের সাথে বরের খাটলিতে বিছানার জন্য মেয়ের বাবাকে একটি শীতল পাটি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। গ্রামীণ জীবনে গ্রীষ্মের তাপদাহে শীতল পাটি বিছিয়ে ঘুমানো ও আড্ডা দেয়া এ অঞ্চলের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল।
শীতলপাটির শিল্প এলাকা বলে সমধিক পরিচিত আছে রায়গঞ্জ উপজেলার আটঘরিয়া, দরবস্ত ও ভেকমপুরের। এ শিল্পের গোড়ার কথা সঠিকভাবে বলা না গেলেও অন্তত ৩শ থেকে ৪শ বছর ধরে এ শিল্পের কাঁচামাল শীতলপাটি বেত’র (পাইত্তা) চাষ হয় বলে জানা যায়। হিন্দু অধ্যুষিত ভেকমপুর, আটঘরিয়া ও দরবস্তের প্রায় ৪ হাজার পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত। সভ্যতার অগ্রগতিতে গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও শীতলপাটি এখনও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। রায়গঞ্জে শীতলপাটি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল সিলেট, নওগা, বগুড়া, বরিশাল, ঢাকাতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি রায়গঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বগুড়ার করতোয়া শাখা নদী ফুলজোড়ের ভাঙ্গণে আটঘরিয়া, দরবস্ত ও ভেকমপুরের ক্রিয়দংশ নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় পাইত্তা চাষ সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও পুজির অভাবে চাহিদা থাকা সত্বেও অনেকেই জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এ শিল্প থেকে দূরে সরে যায়। এর পরেও আটঘরিয়া ও দরবস্তের প্রায় ১ হাজার থেকে ১২শ পরিবার বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। দরিদ্র পরিবারের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই নারী ও শিশুরা পাটি বুননে শ্রম দিয়ে থাকে। ভালো মানের একটি পাটি বুনতে প্রতিটি কারিগরকে ৩ থেকে ৪ দিন কাজ করতে হয়। আর মজুরী পেয়ে থাকে পাটি প্রতি ২শ থেকে ২শ ৫০ টাকা। সারাদেশ থেকে মহাজনেরা কারিগরদের বাড়িতে গিয়ে ভালো মানের একটি পাটি ১২শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায় ক্রয় করে নিয়ে যায়। চৈত্র থেকে ভাদ্র মাসে পাটির চাহিদা বেশি থাকলেও কার্তিক থেকে মাঘ এ চার মাস চাহিদা শূন্যের কোটায় পৌছে যায়। আর এ সময় মহাজনরা পানির দামে পাটি কিনে মজুদ গড়ে তোলে। তারা স্বল্প পুজিওয়ালাদের দাদনও দিয়ে থাকে। সরেজমিনে এ শিল্পের সাথে জড়িত আটঘরিয়া গ্রামের কেশব চন্দ্র দত্ত (১০৫) পিতা- মৃত কৈলাশ চন্দ্র দত্ত, রঘুনাথ চন্দ্র দেব (৮০), পিতা- মৃত অধর চন্দ্র দে, বাবুল চন্দ্র মন্ডল (৫০) পিতা- গনেশ চন্দ্র মন্ডল, মহাদেব চন্দ্র মন্ডল (৪০) পিতা- কানাই চন্দ্র দে, নবকুমার দে (৫০) পিতা- রঘুনাথ চন্দ্র দে’র সাথে কথা বললে তারা যুগান্তর পত্রিকাকে জানান, আমরা পাটি তৈরী করলেও পুজির অভাবে লাভবান হতে পারিনা। একটি পাটি তৈরী করতে বেত, রং ও মজুরী বাবদ প্রায় ১২শ থেকে ১৫শ টাকা খরচ হয়ে যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমে অল্প মুনাফায় বিক্রি করলেও শীতে লোকসান গুনতে হয়। মহাজনেরা শীতে মজুদ গড়ে এ সকল পাটি ২৫শ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে। তাছাড়া এনজিও সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নিয়ে এখানে বিনিয়োগ করলেও কিস্তি পরিশোধ করতে বেশিরভাগ সময়ই হিমশিম খেতে হয়। আবার বেতের সংকট হলে টাঙ্গাইল থেকে চড়া দামে বেত ক্রয় করায় খরচ বেশি পড়ে যায়। তবে নারীরা ঘর-গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে ফাঁকে এবং শিশুরা পাটি বুনতে শ্রম দেয় বলে শিল্পটিকে এখনও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে বলে তারা জানান। এদিকে প্লাষ্টিক দিয়ে তৈরী পাটি এ শিল্প বিকাশে ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করে। প্লাষ্টিকের পাটি স্বাস্থ্য সম্মত না হয়েও সরকার তাদের উৎসাহ যুগিয়ে থাকে বলেও তারা ক্ষোভের সাথে উল্লেখ করেন। অবশ্য এ শিল্পের প্রসার ও বিকাশে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ধানগড়া শাখা একটি ঋণ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে শিল্পের সাথে জড়িত কয়েকটি পরিবারকে ঋণ প্রদান করলেও ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ শিল্প এলাকার ৩টি গ্রামে প্রায় ৩শ একর জমিতে এখনও শীতল পাটির চাষ হয়ে থাকে। এ এলাকায় জন্মানো অন্যান্য ফসলের তুলনায় চাষটি লাভজনক বলে দিন দিন এর ব্যাপকতা বাড়ছে। ভালো পাইত্তা জন্মিলে বছরে গড়ে বিঘায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার পাইত্তা বিক্রি করা যায়। আর এ সকল পাইত্তা থেকে মাসে গড়ে প্রায় ৬ হাজার পিস পাটি তৈরী করা যায়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা। বছরে আসতে পারে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এতদঞ্চলে পূজা-পার্বন ও গদিঘরে বসার জন্য শীতল পাটি চৌকির উপর বিছানা ছাড়াও গ্রাম ও শহরে তাপ রোধক হিসাবে ঘরের সিলিং তৈরীতে শীতলপাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই সম্ভাবনাময় এ শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা দেয়া হলে এ কুটির শিল্পগুলো আরো এগিয়ে যাবে।

লোকসংবাদ | Loksangbad | The First Bangla Online Newspaper from Noakhali সাজসজ্জা করেছেন মুকুল | কপিরাইট © ২০২০ | লোকসংবাদ | ব্লগার

Bim থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.