মো হা ম্ম দ এ হ তে শা মু ল হ ক
গ্রেট ওশান রোড
মহাসমুদ্র মহাসড়ক। নামের অনুবাদ হয় না। না হোক। গ্রেট ওশান রোড আমাদের কাছে আপাতত এটাই। নামেই বিশালতা। মেলবোর্নে এসে গ্রেট ওশান রোডে যাবো না, তা কি হয়? শর্ট ভিজিট। তবু মহাসমুদ্র মহাসড়কের জন্য আগে থেকেই রেখেছিলাম পুরো এক দিন।
নেটে গ্রেট ওশান রোডের দুই পাশের প্রকৃতি দেখে রীতিমতো পাগল হয়ে উঠেছি। বিভোরের (আমার কন্যা) মতো নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করে চলেছি, কখন সকাল হবে!
এমনিতেই নিজে ড্রাইভ করতে চাই না। তার ওপর এ ধরনের ট্রিপে এসব ভাবনা মাথায় আনি না। একটা টিপস দেয়া যাক। বেড়াতে গেলে গাড়ি চালানো, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা- এসব থেকে নিজেকে যতো মুক্ত রাখবেন, ততোই মঙ্গল। আর কিছু নয়, শুধু উপভোগ করুন প্রাণভরে, দৃষ্টিসুখে মজে থাকুন, মুখে গুনগুন আসুক- হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে…।
খুব ভোরে মেলবোর্ন থেকে রওনা হয়ে যাই। গ্রীষ্ম শেষের সকাল। বাংলাদেশে যখন শীত, ইউরোপে হয়তো তুষারপাত- অস্ট্রেলিয়া, তথা পুরো দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গরমকাল। তবে তেমন অসহ্য কিছু নয়।
গো ওয়েস্ট কোম্পানির বাস। পুরো বাসে দক্ষিণ এশীয় শুধু আমরা তিনজন- আমি, আমার স্ত্রী রূপা আর মেয়ে বিভোর। ড্রাইভার নিজেই ট্যুর গাইড। একে একে সবাইকে তুলেই শহর ছেড়ে বাস ছুটছে টর্কওয়ের দিকে। সেই সঙ্গে শুরু হলো ফিলিপের কমেন্ট্রি। অবিরাম।
গ্রেট ওশান রোড কোনো সাধারণ সড়ক নয়। ভিক্টোরিয়া প্রদেশের দুই টর্কওয়ে আর ওয়ার্নামবুলকে লিংক করেছে ২৪৩ কিলোমিটারের এই সড়ক। দিনে দিনে মেলবোর্নে ফেরার প্ল্যান। সে জন্য আমরা বিখ্যাত টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস পর্যন্ত যাব। সেটিই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
অনেকে দু-তিন দিন সময় নিয়ে আসে। মেলবোর্ন থেকে দক্ষিণ মহাসাগরের পাশ ঘেঁষে এই অনিন্দ্যসুন্দর পথ বেয়ে পাড়ি জমান অ্যাডিলেডে। কেউ বা আসেন উল্টো পথে।
প্রায় এক ঘণ্টা পর, মেলবোর্ন শহর আর শহরতলি পেরিয়ে পৌঁছাই টর্কওয়ে। এখান থেকে মহাসমুদ্র মহাসড়কের শুরু। বিশ্বের সবচেয়ে নৈসর্গিক শোভামন্ডিত রাস্তা। ডান পাশে সবুজ অরণ্য আর পাহাড়, বাঁ দিকে তাকালে সমুদ্র। তুলনাহীন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিরে আসা সেনাদের দিয়েই শুরু হয় নির্মাণকাজ। এখানে জঙ্গল তখন এত ঘন ছিল যে জরিপকাজ চলতো পুরো মাসে মাত্র তিন কিলোমিটার। গ্রেনেড দিয়ে পাথুরে পাহাড় ভেঙে এগিয়ে যেতে হতো। সারা দিন আট ঘণ্টা খাটুনির পর একেকজন পেতো দশ শিলিং আর একটা সিক্সপেন্স তাম্রমুদ্রা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম হলেও বিনোদনের অপার ব্যবস্থা ছিল- পিয়ানো, গ্রামোফোন, খেলাধুলা, ক্যাসিনো- কী নয়?
টর্কওয়েতে যাত্রাবিরতি ছিল আধঘণ্টার। দারুণ সব সৈকতের সমাহার। ইংল্যান্ডের টর্কওয়ে শহরের মিতা। শহরের অদূরে বেলস্ বিচ, সার্ফারদের স্বর্গ নামে সমধিক পরিচিত। বালুরাশিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে একটু অবসন্ন হয়ে পড়ি। তখনই ফিলিপের ডাক, ‘টি-কফি-কুকিজ রেডি!’
ফিলিপের অনর্গল বকবকানি চলছেই। কানে কিছু ঢুকছে, তো কিছু নয়। চোখ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইতোমধ্যেই। পাহাড়ের গা ঘেঁষে পথ, অনতিদূরে সমুদ্র। এ ছবি এত দিন শুধু সিনেমাতেই দেখেছি।
কিছুদূর পর পর লুক-আউট পয়েন্ট। বাস থামছে সেসব জায়গায়। ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক চলছে। কখনো নীল ফেনিল জলরাশির দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকা। রূপার গলায় উচ্ছ্বাস আর ধরে না। বিভোর এরই মধ্যে ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে। দূরের পথ। কিন্তু থেমে থেমে যাচ্ছি বলে ততোটা ক্লান্তি নেই। দিনের আবহাওয়াও দারুণ। নাতিশীতোষ্ণ।
ক্রমান্বয়ে পার হচ্ছি একের পর এক ছোট ছোট জনপদ: অ্যাংলিসিয়া, এয়ারিস ইনলেট, লর্ন ইত্যাদি। সৌন্দর্যে কেউ কারও চেয়ে কম নয়। পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠেছে বেশ ক’টি হোটেল। অ্যাপার্টমেন্টও আছে বেশ কিছু। গাইডের মুখে শুনেছি, এসব বাড়ির দাম কয়েক মিলিয়ন ডলার। অনেক হলিউড তারকার বাড়িও নাকি আছে এখানে।
টর্কওয়ে থেকে আরও ৯০ কিলোমিটার পর অ্যাপোলো বে। শহরটি অন্যগুলোর চেয়ে একটু বড়। সার বাঁধা রেস্তোরাঁ আছে কয়েকটা। বেছে বেছে একটায় ঢুকে পড়ি। এসব সময়ে বেচারা রূপার জন্য আফসোসই হয়। বিভোরকে খাইয়ে নিজে কিছু মুখে দিতে না-দিতেই ফিলিপের ডাক। কিছু চিপস আর বিস্কুট কিনে নিলাম।
পথটার বর্ণনা আর কী দেবো? যত যা-ই লিখি, সেই অনুভূতির ধারে-কাছে যাওয়া অসম্ভব। প্রিয় পাঠক, ঘোলে আসলেই মেটে না দুধের স্বাদ।
আরেকটা জায়গায় থামলো বাস। নামটা এখন আর মনে নেই। জায়গাটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একটু উপরে। পার্কের মতো। সবুজ ঘাস। বেঞ্চি পাতাও রয়েছে কয়েকটি। পেটে দানাপানি পড়ায় বিভোরও বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। এখন ঝকঝকে রোদ। আমরা মেতে উঠি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায়।
বিকেলের দিকে ক্লান্তি ভর করে। কিন্তু ক্লান্ত হলে চলবে কী করে? আসল আকর্ষণই যে বাকি! টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস। পোর্ট ক্যাম্পবেল ন্যাশনাল পার্কের পাশে। যখন পৌঁছাই, তখন বিকেল। একটু মেঘও করেছে। বাস থেকে নেমে এ আমি কী দেখছি! সৈকত ছাড়িয়ে বেল খানিকটা ভেতরে। বিশাল শিলাখন্ডের মতো। বিচ্ছিন্ন। দক্ষিণ মহাসাগরের উদ্দামতায় শিলাখ- ক্ষয়ে কীভাবে যেন এ আকৃতি পেয়েছে। একেকটা একেক রকম। কোনোটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলুপ্তপ্রায়। কোনো মতে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটি এখনো বেশ স্বাস্থ্যবতী।
এমন দৃষ্টিসুখকর দৃশ্য জীবনে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুধু আমার নয়। সবারই মুগ্ধতাভরা চাহনি। রোদ পড়ে গেছে। তবু সুন্দর। বুঝতে চাইছি, বৃষ্টির সময় কেমন লাগতো। একেক আলোয় একেক চেহারা নেয়ার কথা। শেষ বিকেলের সোনা রোদে স্বর্গীয় আভা। কে যেন পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। নড়তেই পারছি না। অনেকক্ষণ কেটে গেল। তড়িঘড়ি কয়েকটি ছবিও তোলা হলো।
মাঝে মাঝে ফিলিপকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছি এটা-ওটা। একটু দূরে দেখা যাচ্ছিল লন্ডন আর্ক। আগে বলা হতো লন্ডন ব্রিজ। নিচের দিকে মাটি ক্ষয়ে সেতুর মতোই নাকি দেখাতো! ১৯৯০ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রায় আচমকাই ধসে পড়ে লন্ডন সেতুর পুরো ভাগ। এর আগে পর্যটকরা ব্রিজ পেরিয়ে শেষ মাথায় যেতে পারতেন। সেদিনও তাই হয়েছিল। ব্রিজ ধসে পড়ায় দুজন পর্যটক আটকা পড়েন অন্য প্রান্তে। পরে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করতে হয়। লন্ডন ব্রিজ নাম বদলে হয়ে যায় আর্ক।
ন্যাশনাল পার্কের আরেক সেরা আকর্ষণ ছিল লক আর্ড জর্জ। টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস থেকে আরও কিছু দূরে পশ্চিমে গেলে এর অবস্থান। লক আর্ড নামে একটি জাহাজ ১৮৭৮-এ মেলবোর্নে পাড়ি জমিয়েছিল ইংল্যান্ড থেকে। সৈকতের কাছাকাছি এসে দুর্ঘটনায় পড়ে। পঞ্চান্ন যাত্রীর মধ্যে বেঁচে যান মাত্র দুজন। ১৫ বছরের বালক টম পিয়ার্স, যে ছিল নবিশ নাবিক। আর ১৭ বছরের তরুণী ইভা কারমাইকেল। আইরিশ এই পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছিল ভাগ্যান্বেষণে। পরে ইভা আর থাকেননি অস্ট্রেলিয়ায়। মাস তিনেক থেকে ফিরে যান। পিয়ার্স হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর নাবিক। বছর কয়েক পরে আরেক দুর্ঘটনায় সমুদ্র কেড়ে নেয় তাকে।
মাঝের আর্চওয়ে ভেঙে পড়ে ২০০৯ সালে। তাতে সৌন্দর্য যেন বেড়েছে আরও। দুই শিলাখন্ডের দুটি প্রান্ত যেন চুম্বনরত। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া দুজনের নামে ডাকা হয় ওদের- টম আর ইভা।
এমনিতেই নিজে ড্রাইভ করতে চাই না। তার ওপর এ ধরনের ট্রিপে এসব ভাবনা মাথায় আনি না। একটা টিপস দেয়া যাক। বেড়াতে গেলে গাড়ি চালানো, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা- এসব থেকে নিজেকে যতো মুক্ত রাখবেন, ততোই মঙ্গল। আর কিছু নয়, শুধু উপভোগ করুন প্রাণভরে, দৃষ্টিসুখে মজে থাকুন, মুখে গুনগুন আসুক- হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে…।
খুব ভোরে মেলবোর্ন থেকে রওনা হয়ে যাই। গ্রীষ্ম শেষের সকাল। বাংলাদেশে যখন শীত, ইউরোপে হয়তো তুষারপাত- অস্ট্রেলিয়া, তথা পুরো দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গরমকাল। তবে তেমন অসহ্য কিছু নয়।
গো ওয়েস্ট কোম্পানির বাস। পুরো বাসে দক্ষিণ এশীয় শুধু আমরা তিনজন- আমি, আমার স্ত্রী রূপা আর মেয়ে বিভোর। ড্রাইভার নিজেই ট্যুর গাইড। একে একে সবাইকে তুলেই শহর ছেড়ে বাস ছুটছে টর্কওয়ের দিকে। সেই সঙ্গে শুরু হলো ফিলিপের কমেন্ট্রি। অবিরাম।
গ্রেট ওশান রোড কোনো সাধারণ সড়ক নয়। ভিক্টোরিয়া প্রদেশের দুই টর্কওয়ে আর ওয়ার্নামবুলকে লিংক করেছে ২৪৩ কিলোমিটারের এই সড়ক। দিনে দিনে মেলবোর্নে ফেরার প্ল্যান। সে জন্য আমরা বিখ্যাত টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস পর্যন্ত যাব। সেটিই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
অনেকে দু-তিন দিন সময় নিয়ে আসে। মেলবোর্ন থেকে দক্ষিণ মহাসাগরের পাশ ঘেঁষে এই অনিন্দ্যসুন্দর পথ বেয়ে পাড়ি জমান অ্যাডিলেডে। কেউ বা আসেন উল্টো পথে।
প্রায় এক ঘণ্টা পর, মেলবোর্ন শহর আর শহরতলি পেরিয়ে পৌঁছাই টর্কওয়ে। এখান থেকে মহাসমুদ্র মহাসড়কের শুরু। বিশ্বের সবচেয়ে নৈসর্গিক শোভামন্ডিত রাস্তা। ডান পাশে সবুজ অরণ্য আর পাহাড়, বাঁ দিকে তাকালে সমুদ্র। তুলনাহীন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিরে আসা সেনাদের দিয়েই শুরু হয় নির্মাণকাজ। এখানে জঙ্গল তখন এত ঘন ছিল যে জরিপকাজ চলতো পুরো মাসে মাত্র তিন কিলোমিটার। গ্রেনেড দিয়ে পাথুরে পাহাড় ভেঙে এগিয়ে যেতে হতো। সারা দিন আট ঘণ্টা খাটুনির পর একেকজন পেতো দশ শিলিং আর একটা সিক্সপেন্স তাম্রমুদ্রা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম হলেও বিনোদনের অপার ব্যবস্থা ছিল- পিয়ানো, গ্রামোফোন, খেলাধুলা, ক্যাসিনো- কী নয়?
টর্কওয়েতে যাত্রাবিরতি ছিল আধঘণ্টার। দারুণ সব সৈকতের সমাহার। ইংল্যান্ডের টর্কওয়ে শহরের মিতা। শহরের অদূরে বেলস্ বিচ, সার্ফারদের স্বর্গ নামে সমধিক পরিচিত। বালুরাশিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে একটু অবসন্ন হয়ে পড়ি। তখনই ফিলিপের ডাক, ‘টি-কফি-কুকিজ রেডি!’
সমুদ্রতীর ঘেঁষে মহাসড়ক ধরে ভ্রমণ সব সময়ই রোমাঞ্চকর। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ওশান রোডে একটা প্লিজার ট্রিপ- ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। কারণ, দু’পাশের নিসর্গসৌন্দর্যের পাশাপাশি ইতিহাসের নানা রসদও তো এই ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে ওঠে। লিখেছেন মোহাম্মদ এহতেশামুল হক
ফিলিপের অনর্গল বকবকানি চলছেই। কানে কিছু ঢুকছে, তো কিছু নয়। চোখ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইতোমধ্যেই। পাহাড়ের গা ঘেঁষে পথ, অনতিদূরে সমুদ্র। এ ছবি এত দিন শুধু সিনেমাতেই দেখেছি।
কিছুদূর পর পর লুক-আউট পয়েন্ট। বাস থামছে সেসব জায়গায়। ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক চলছে। কখনো নীল ফেনিল জলরাশির দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকা। রূপার গলায় উচ্ছ্বাস আর ধরে না। বিভোর এরই মধ্যে ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে। দূরের পথ। কিন্তু থেমে থেমে যাচ্ছি বলে ততোটা ক্লান্তি নেই। দিনের আবহাওয়াও দারুণ। নাতিশীতোষ্ণ।
ক্রমান্বয়ে পার হচ্ছি একের পর এক ছোট ছোট জনপদ: অ্যাংলিসিয়া, এয়ারিস ইনলেট, লর্ন ইত্যাদি। সৌন্দর্যে কেউ কারও চেয়ে কম নয়। পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠেছে বেশ ক’টি হোটেল। অ্যাপার্টমেন্টও আছে বেশ কিছু। গাইডের মুখে শুনেছি, এসব বাড়ির দাম কয়েক মিলিয়ন ডলার। অনেক হলিউড তারকার বাড়িও নাকি আছে এখানে।
টর্কওয়ে থেকে আরও ৯০ কিলোমিটার পর অ্যাপোলো বে। শহরটি অন্যগুলোর চেয়ে একটু বড়। সার বাঁধা রেস্তোরাঁ আছে কয়েকটা। বেছে বেছে একটায় ঢুকে পড়ি। এসব সময়ে বেচারা রূপার জন্য আফসোসই হয়। বিভোরকে খাইয়ে নিজে কিছু মুখে দিতে না-দিতেই ফিলিপের ডাক। কিছু চিপস আর বিস্কুট কিনে নিলাম।
পথটার বর্ণনা আর কী দেবো? যত যা-ই লিখি, সেই অনুভূতির ধারে-কাছে যাওয়া অসম্ভব। প্রিয় পাঠক, ঘোলে আসলেই মেটে না দুধের স্বাদ।
আরেকটা জায়গায় থামলো বাস। নামটা এখন আর মনে নেই। জায়গাটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একটু উপরে। পার্কের মতো। সবুজ ঘাস। বেঞ্চি পাতাও রয়েছে কয়েকটি। পেটে দানাপানি পড়ায় বিভোরও বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। এখন ঝকঝকে রোদ। আমরা মেতে উঠি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায়।
বিকেলের দিকে ক্লান্তি ভর করে। কিন্তু ক্লান্ত হলে চলবে কী করে? আসল আকর্ষণই যে বাকি! টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস। পোর্ট ক্যাম্পবেল ন্যাশনাল পার্কের পাশে। যখন পৌঁছাই, তখন বিকেল। একটু মেঘও করেছে। বাস থেকে নেমে এ আমি কী দেখছি! সৈকত ছাড়িয়ে বেল খানিকটা ভেতরে। বিশাল শিলাখন্ডের মতো। বিচ্ছিন্ন। দক্ষিণ মহাসাগরের উদ্দামতায় শিলাখ- ক্ষয়ে কীভাবে যেন এ আকৃতি পেয়েছে। একেকটা একেক রকম। কোনোটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলুপ্তপ্রায়। কোনো মতে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটি এখনো বেশ স্বাস্থ্যবতী।
এমন দৃষ্টিসুখকর দৃশ্য জীবনে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুধু আমার নয়। সবারই মুগ্ধতাভরা চাহনি। রোদ পড়ে গেছে। তবু সুন্দর। বুঝতে চাইছি, বৃষ্টির সময় কেমন লাগতো। একেক আলোয় একেক চেহারা নেয়ার কথা। শেষ বিকেলের সোনা রোদে স্বর্গীয় আভা। কে যেন পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। নড়তেই পারছি না। অনেকক্ষণ কেটে গেল। তড়িঘড়ি কয়েকটি ছবিও তোলা হলো।
মাঝে মাঝে ফিলিপকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছি এটা-ওটা। একটু দূরে দেখা যাচ্ছিল লন্ডন আর্ক। আগে বলা হতো লন্ডন ব্রিজ। নিচের দিকে মাটি ক্ষয়ে সেতুর মতোই নাকি দেখাতো! ১৯৯০ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রায় আচমকাই ধসে পড়ে লন্ডন সেতুর পুরো ভাগ। এর আগে পর্যটকরা ব্রিজ পেরিয়ে শেষ মাথায় যেতে পারতেন। সেদিনও তাই হয়েছিল। ব্রিজ ধসে পড়ায় দুজন পর্যটক আটকা পড়েন অন্য প্রান্তে। পরে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করতে হয়। লন্ডন ব্রিজ নাম বদলে হয়ে যায় আর্ক।
ন্যাশনাল পার্কের আরেক সেরা আকর্ষণ ছিল লক আর্ড জর্জ। টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস থেকে আরও কিছু দূরে পশ্চিমে গেলে এর অবস্থান। লক আর্ড নামে একটি জাহাজ ১৮৭৮-এ মেলবোর্নে পাড়ি জমিয়েছিল ইংল্যান্ড থেকে। সৈকতের কাছাকাছি এসে দুর্ঘটনায় পড়ে। পঞ্চান্ন যাত্রীর মধ্যে বেঁচে যান মাত্র দুজন। ১৫ বছরের বালক টম পিয়ার্স, যে ছিল নবিশ নাবিক। আর ১৭ বছরের তরুণী ইভা কারমাইকেল। আইরিশ এই পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছিল ভাগ্যান্বেষণে। পরে ইভা আর থাকেননি অস্ট্রেলিয়ায়। মাস তিনেক থেকে ফিরে যান। পিয়ার্স হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর নাবিক। বছর কয়েক পরে আরেক দুর্ঘটনায় সমুদ্র কেড়ে নেয় তাকে।
মাঝের আর্চওয়ে ভেঙে পড়ে ২০০৯ সালে। তাতে সৌন্দর্য যেন বেড়েছে আরও। দুই শিলাখন্ডের দুটি প্রান্ত যেন চুম্বনরত। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া দুজনের নামে ডাকা হয় ওদের- টম আর ইভা।
- লেখক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
- ছবি: লেখক