সর্বশেষ

শান্ত সৌন্দর্যের দেশে

 মো হা ম্ম দ   এ হ তে শা মু ল   হক

 শান্ত সৌন্দর্যের দেশে

নিউজিল্যান্ডের নিসর্গ।  নদী, হ্রদ, পাহাড়।  প্রকৃতি যেভাবে দেশটিকে সাজিয়েছে, তেমনি সেখানকার মানুষও সেগুলো উপভোগের ব্যবস্হা করে রেখেছে।  সবই মনোমুগ্ধকর।  লিখেছেন মোহাম্মদ এহতেশামুল হক

হালকা-পাতলা গড়ন।  তবে রোগা নয়।  পাট ভাঙা শাদা শার্ট, কালো প্যান্ট।  মাথায় হ্যাট।  অ্যারনকে ঠিক মাঝি বলা যাচ্ছে না।  টিকিট কাউন্টারের লোকটা একটু পর ওরই হাতে বৈঠা ধরিয়ে দিল।  বললো, সাবধানে।

ততোক্ষণে আমরা ডিঙিতে বসেছি।  সামনে আমি আর রূপা, আমার অর্ধাঙ্গিনী।  বিভোর কোলে।  আমাদের ঠিক পেছনেই প্রায় সমবয়সী চীনা নবদম্পতি।

নৌকায় উঠেই বোটম্যান-কাম-ট্যুর গাইড অ্যারন বলছে, নদীর নাম অ্যাভন।  আমার নামের সঙ্গে মিল আছে।  হেসে উঠি সবাই।  সশব্দে।

অ্যাভন শব্দের অর্থই হলো নদী।  নদীর নাম নদী! অদ্ভুত!

ছেলেবেলায় পড়তাম, শেকসপিয়র জন্মেছেন অ্যাভন নদীর তীরে।  আমরা এখন যে অ্যারন মাঝির ডিঙিতে দুলছি, শেকসপিয়রের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভন থেকে তা বিশ হাজার কিলোমিটার দূরে।  ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড পৃথিবীর দুই প্রান্তভূমি।  এই অ্যাভন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের মাঝ বরাবর বয়ে চলা শান্ত, শীতল নদী।

পরে জেনেছি, অ্যাভন নামে অন্তত সতেরোটি নদী আছে এখানে-সেখানে- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা আর নিউজিল্যান্ডে।  একই নামে এত কেন নদী? নামের কি অভাব পড়লো তোমাদের? ধার চাও আমাদের কাছে।  মধুমতী, মহানন্দা, না ময়ূরপঙখী? তিস্তা, তিতাস, না ধলেশ্বরী? কোনটা নেবে?

অগভীর নদীতে দাঁড় বাইছে যুবক।  ভাগ্যান্বেষণে এখানে এসেছে সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে।  সন্ধ্যায় পার্টটাইম পড়াশোনা, দিনে ডিঙি বাওয়া।  নদীর দু’পাশে সবুজের বিন্যাস।  অদূরে কোথাও স্কুল, কোথাও ক্লাবঘর, রেস্তোরাঁ, পার্ক।  যেন থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।  দু’পাশের গাছগাছালি কখনো সবুজ, কখনো হলুদ বা লালচে।  নৈঃশব্দ্যের মধ্য দিয়ে চলেছি।  মাঝে মাঝে চীনা দম্পতির অনুচ্চ কণ্ঠ, খুনসুটি।  অ্যারনের সঙ্গে চলছে আলাপ, আর্জেন্টিনা থেকে নিউজিল্যান্ডে আসার কারণ, বিশ্বমন্দা ছাড়িয়ে ‘ম্যারাডোনা না মেসি- কে বড়’- এ অবধি পৌঁছায়।

হঠাৎ প্রশ্ন অ্যারনের, তোমরা বাংলাদেশ থেকে? চমকে উঠলাম।  এই বুঝি ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দারিদ্র্য আর দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করে।  চোখ নাচিয়ে বললো সে, ইউনূসকে চেনো? মুহাম্মদ ইউনূস? ব্যাংকার্স টু দ্য পুওর! হি ইজ মাই হিরো।  আমরা অবাক।  মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি রূপা আর আমি।  ও বলে চলে, দারিদ্র্য-তাড়ানো দারুণ সব আইডিয়া তাঁর মাথায়।  আমার কাছে তিনি ম্যারাডোনা-মেসির চেয়েও অনেক বড়।

অ্যারনের স্বপ্ন, বাংলাদেশে এসে ইউনূসের সঙ্গে দেখা করবে।  আর কিছু পয়সা জমলেই।  নিউজিল্যান্ডের স্রোতহীন নদীতে আর্জেন্টাইন যুবকের মুখে নিজের দেশের সাফল্যগাথা শুনে আনন্দে চোখের পাতা ভিজে আসে।  অ্যারন তখন দু’পাশের লোকালয় দেখিয়ে বলে, অ্যাভনসাইড, ওই দিকে ডার্লিংটন, আরেকটু এগোলে অ্যাভনডেল, আরালুই।

দারুণ সুখানুভূতি নিয়ে সিটি সেন্টারে ফিরে আসি।

নিউজিল্যান্ডে যাবো, প্ল্যান চলছিল অনেক দিন থেকে।  অস্ট্রেলিয়া থেকে এক মাসের ভিসা পেতেও সমস্যা হয়নি।  পুরো দেশ দেখার জন্য ত্রিশ দিন অযথেষ্ট।  আমাদের সময়-অর্থ, দুই-ই সীমিত।  আট দিনের সফরসূচি তৈরি হলো।  নর্থ আইল্যান্ডের প্রধান দুই শহর- অকল্যান্ড আর ওয়েলিংটন।  নাগরিক সংস্কৃতি।  সবাই বলে, অনেকটা মেলবোর্নের মতো স্হাপত্য।  শুধু নিসর্গে ডুবে থাকতে চাইলে সাউথ আইল্যান্ড।  ঠিক হলো, দক্ষিণেই যাবো।  ক্রাইস্টচার্চ, কুইন্সটাউন, তে আনাউ আর মিলফোর্ড সাউন্ড।  এই হলো কিউইল্যান্ড প্ল্যান।

ক্যানবেরা থেকে সিডনি হয়ে ক্রাইস্টচার্চ বিমানবন্দরে যখন ভার্জিন আটলান্টিকের উড়ালযান ল্যান্ড করে, দুপুর পেরিয়ে গেছে।  নিউজিল্যান্ডের সব এয়ারপোর্টে খুব কড়াকড়ি।  রোগজীবাণু নিয়ে খুব সতর্ক ওরা।  প্রাণিজ কোনো উপাদান যেন না আসে, সেদিকে খুব খেয়াল।  আমাদের এয়ারপোর্টে সতর্ক দৃষ্টি থাকে সোনা-ডলার টাকা চোরাচালান, শুল্ক ফাঁকি- এসবের দিকে।  ওদের তালিকায় সর্বাগ্রে সংবাহীনিরোধ।  জীবাণু যেন কোনোক্রমেই না আসে।  কাস্টমসের এক প্রশিক্ষিত কুকুর ঘুরঘুর করছে রূপার চারপাশে।  অফিসার এগিয়ে এসে বললো, ফর সাম রিজন্স, শি (কুকুর) ইজ ইন্টারেস্টেড।  আমাকে তোমাদের ব্যাগ খোলার অনুমতি দাও।  তেমন কিছু না, বিভোরের জন্য রান্না করে আনা নুড্‌লসে ডিম ছিল।  এ জন্যই কুকুরটির এত কৌতূহল।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই আরেক অভিজ্ঞতা।  শাটল ডেকে তুললো।  হোটেলের নাম জেনে নিয়ে বললো, চলো, তোমাদের বিনা পয়সায় পৌঁছে দেব।  মিউনিসিপ্যালিটির সৌজন্যে।  পর্যটকদের প্রতি শুভেচ্ছা।  লেট লাঞ্চ সেরে ক্লান্ত তিনজনই।  ওই দিন আর কিছু নয়।  হোটেলের ধারেকাছে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাই- নবান্ন রেস্তোরাঁ।  যা ভেবেছিলাম, তা-ই।  বাঙালি মালিক।  দুই বন্ধু মিলে চালাচ্ছেন।  বছর তিনেক ধরে।  দূরদেশে স্বদেশি মানুষের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পেরে কী যে ভালো লাগে! ওদের কাছে জানলাম, ক্রাইস্টচার্চে বাঙালি বেশি নেই।  চল্লিশ ঘর মতো হবে।  দেশ থেকে কেউ সরকারি সফরে এলে এই রেস্তোরাঁয় একটা পার্টি হবেই।  বিখ্যাত কারা সম্প্রতি এসেছেন, ফিরিস্তি শুনি।  খাবারের মান ভালো।  দাম ন্যায়সঙ্গত।

পরদিন সকালে চলে আসি ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে।  ইস্তাম্বুলের যেমন তাকসিম স্কয়ার, বেইজিংয়ের যেমন তিয়েনআনমেন স্কয়ার, লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ার, ক্রাইস্টচার্চের তেমন ক্যাথেড্রাল স্কয়ার।  শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে এর অবস্হান।

স্কয়ারের মাঝামাঝি চ্যালিস নামের চোঙাকৃতি যে ভাস্কর্য, এটি ক্রাইস্টচার্চের সিগনেচার স্পট।  ২০০১ সালে ঘরের ছেলে নেল ডসন এর নকশা তৈরি করেন।  স্টিলের ষড়ভুজাকৃতি কারুকার্য।  গ্রাউন্ড লেভেলে ব্যাস ২ মিটার, আর সাড়ে ১৮ মিটার উচ্চতায় চোঙের ব্যাস ৯ মিটার।  ঝকঝকে।  সূর্যের আলো স্টিলের ওপর পড়ে শোভা বাড়িয়েছে অনেক।  পর্যটকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যার যেমন খুশি।  এক পাশে চলছে দাবার আসর।

ট্রামযোগে সিটি ট্যুরের সিদ্ধান্ত নিলাম।

একসময় ট্রামই ছিল এখানকার প্রধান বাহন।  এখন আড়াই কিলোমিটারের সেন্ট্রাল সিটি লুপে শুধু পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।  ৪৮ ঘণ্টার টিকিট সংগ্রহ করি।  হপ অন, হপ অফ সার্ভিস।  লাল-হলুদ ট্রামের শব্দে হারিয়ে যাই।  মনে হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে আছি।  আর্ট গ্যালারি, জাদুঘর, অ্যাভন নদী, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বিশ্ববিদ্যালয়- একের পর এক স্টপ।  কোথাও নামি, আবার ক্লান্ত হলে ট্রামে বসে থাকি।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটে ট্রাম থেকে নামি।  ১৮৬৬ সালে নিঃসঙ্গ এক বটগাছ ছিল এখানে।  তার চারপাশে হাজার রকমের গাছ।  পাখিকুলের সুরেলা আওয়াজে মনে পুলক জাগে।  মন্দা, ভূমিকম্প, ঝড়ঝাপ্টা- কী নেই? কিন্তু এই উদ্যান আছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চিহ্ন হয়ে।  অম্লান।

দুপুরে হালকা কিছু খেয়ে নৌকাভ্রমণ।  সে গল্প তো শুরুতেই হলো।  ভিজিটর সেন্টার থেকে জানলাম- কায়কুরা বলে একটা জায়গা আছে।  সেখান থেকে তিমি আর ডলফিন দেখার ক্রুজশিপ ছাড়ে।  সৈকত ঘেঁষে যেতে হয়।  বাসে আড়াই ঘণ্টা, তারপর জাহাজ।  রূপা শুনেই অস্হির হয়ে উঠেছে।  ওখানে সে যাবেই যাবে।  পকেটের ভগ্নস্বাস্হ্য অগ্রাহ্য করে বললাম, চলো।  কিন্তু বাসস্টপে গিয়ে শুনি, দুপুরের পরে কোনো জাহাজ নেই।  জানানো হলো, কাল ভোরে এলে জাহাজ পাওয়া যাবে।  তা আর হবার নয়।  পরদিন আমাদের প্ল্যান, ট্রান্স আলপাইন ট্রেন ভ্রমণ।

দু’পাশের দৃশ্যাবলির জন্য ট্রান্স-আলপাইন পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ট্রেন ভ্রমণ।  পর্যটকরা এখানে এসে এই সুযোগ কখনো ছাড়ে না।  ক্রাইস্টচার্চ থেকে গ্রেমান্ডথ।  দুলে দুলে চলা এই ট্রেনে ১২৪০ কিলোমিটার যেতে লাগে সাড়ে চার ঘণ্টা।  ডে-টিকিট নিলাম।  যাব, ঘণ্টা দুই বেড়ানো, খাওয়া।  ফিরতি ট্রেনে চলে আসবো।

এ সফর এত প্রিয় কেন, তা জানতে সময় লাগে না।  ট্রেন ছাড়লো সকাল সোয়া আটটায়।  দু’পাশে লোকালয় দেখি মিনিট দশেকের মতো।  অ্যাডিংটন সিমেন্ট কারখানা, ফ্রেইট ইয়ার্ড ছাড়িয়ে ক্যান্টারবারি সমতল।  আবাদভূমি, খামার।  ভেড়ার পাল চরছে, কোথাও কোথাও গরুর খামার।  বাংলাদেশের টিভিতে নিউজিল্যান্ড মিল্ক প্রডাক্টসের বিজ্ঞাপন মনে পড়ে।  সেই বিজ্ঞাপনের মতোই নাদুসনুদুস গরুর পাল।  লাল হরিণের ঝাঁক।  ছোট্ট শহর ডারফিল্ড পেরিয়ে ন’টার দিকে পৌঁছাই স্প্রিংফিল্ডে।  এখান থেকে ট্রেনে মাফিন ওঠে।  একটু পর আসে মাফিন, সঙ্গে কফি।  দূর-দিগন্তে তুষারাবৃত সাদার্ন আল্পস, সামনে ধোঁয়া ওঠা কফি।  আহ্‌্‌! লাইফ ইজ বিউটিফুল।

সোয়া ন’টার দিকে আমাদের ট্রেন আল্পস পাড়ি দিতে থাকে, ডানে তখন ওয়াইমাকিরিরি নদীর নীল জল।  পাহাড়ে উঠছে ট্রেন, পাড়ি দিচ্ছে সেতু, আর কয়েকটি সুড়ঙ্গ।  এখানকার নামকরা সেতু হলো- স্টেয়ারকেস।  নদী-সমতল থেকে ৭৩ মিটার উঁচুতে।  প্রকৃতি এখানে অকৃপণ বিলিয়েছে সৌন্দর্য।

পাহাড়-নদীর লুকোচুরি শেষে সোয়া দশটায় আমরা পৌঁছাই আর্থার পাস স্টেশনে।  বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।  এখানে মিনিট দশেকের বিরতি।  একটু শীত শীত ভাব।  রূপা-বিভোর নামলো না।  আমি ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়ি।  স্টেশনের চারপাশে পর্বত, বনানী।  রসাস্বাদন করছি অবিরত, কখনো নিজের চোখে, কখনো ক্যামেরায়।

আথরি পাস ছাড়িয়েই ট্রেন ঢুকে যায় ওটিরা সুড়ঙ্গে।  নয় কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ, নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘ সুড়ঙ্গগুলোর একটি।  ১৯২৩ সালে নির্মিত।  সাউথ আইল্যান্ডের পূর্ব-পশ্চিমকে যুক্ত করতেই তৈরি করা হয়েছে এটি।  ওটিরা রেলওয়ে টাউন।  পশ্চিমাংশের সব কয়লাখনি থেকে এখানেই কয়লা বোঝাই করা হতো রেলগাড়িতে।  এখান থেকেই পাঠানো হতো ক্রাইস্টচার্চ এবং অন্যান্য শহরে।

ট্রেন চলছে দুলে দুলে, অনেকটা নিঃশব্দে।  নৈসর্গিক শোভা চারপাশে।  পর্বতশীর্ষে সাদা টুপির তুষারাচ্ছাদন।  যতো দূর চোখ যায়, পর্বত, নদী, নয়তো হ্রদ।

এত সুন্দর হয় কোনো দেশ!

[পুনশ্চ ১: ২০১১ সালের ভূমিকম্প ভেঙে দেয় ক্রাইস্টচার্চের বেশ কিছু পরিচিত স্হাপনা।  ক্যাথেড্রাল আর জাদুঘরের কিছু অংশ ধসে পড়ে।  টিভিতে দেখে আমাদের চোখ ভিজে আসে।]
  • লেখক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
  • ছবি: লেখক

লোকসংবাদ | Loksangbad | The First Bangla Online Newspaper from Noakhali সাজসজ্জা করেছেন মুকুল | কপিরাইট © ২০২০ | লোকসংবাদ | ব্লগার

Bim থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.