আবু নাছের মঞ্জ, নোয়াখালী:
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতয়ার চরাঞ্চলে ধান কাটার মওসুমে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দখল পাল্টা দখলের খেলায় মেতে উঠছে বিভিন্ন দস্যু বাহিনী। গত কয়েক বছর থেকে দস্যু বাহিনীর চর দখলের খেলায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে এসব এলাকায় বসবাসরত ২০ হাজার পরিবার। গত কয়েক দিনে দস্যু বাহিনীর দখল পাল্টা দখলের খেলায় চরগুলোতে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত বনদস্যু বাশার মাঝির স্থলাভিষিক্ত নাসির কমাণ্ডারের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
গত সোমবার থেকে চরাঞ্চলে র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু হলে নাসির কমাণ্ডার তার বাহিনী নিয়ে চর থেকে সরে পড়ে। কিন্তু মাত্র একদিনেই র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দস্যু বাহিনী আবার ফিরে এসে তাণ্ডব চালাতে পারে এমন আশংকায় চরের মানুষ এখন শংকিত।
চরাঞ্চচলের ভূমিহীনরা জানায়, চর নঙ্গলিয়া, নলের চর, কেরিংচর, চর বাশার ও জাহাজিয়ার চরসহ আশপাশের চরাঞ্চল এককভাবে নিয়ন্ত্রন করতো বনদস্যু বাশার বাহিনী। গত ৬ জুন ভোরে র্যাবের সাথে ক্রসফায়ারে বাশার মাঝি নিহত হবার পর তার বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবেব নাসির কমান্ডার {বাশার মাঝির কেরানী}কে বাহিনীর দলনেতার দায়িত্ব দেয়। এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট প্রধান মিয়া শিকদার, কাসেম, বাগরাজ, বাবর কসাই, বাহার কেরানী, ইসমাইল, মালেক ফরাজী, এমরান ও নিজামসহ কয়েকজন নাসির কমাণ্ডারের সাথে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। চরাঞ্চলে আমন ধান পাকতে শুরু করায় চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ন্ত্রনে রাখতে প্রকাশ্যে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এসব বাহিনী।
নলের চরের আবুল কাসেম, জনতা বাজারের জয়নাল আবেদীন, কেরিং চরের বদিউল আলম ও চর বাশারের মিরাজ উদ্দিন জানান, নাসির কমাণ্ডারকে চর থেকে উৎখাত করতে মিয়া সিকদারের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সংঘবদ্ধ হয়ে গত ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাহাজিয়ার চরে সশস্ত্র হামলা চালায়। হাতিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ত্রাস মুন্সিয়া চোরা, জলদস্যু গিয়াস উদ্দিন প্রকাশ গেইস্যা ডাকাত দলবল নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়। এসকল দস্যু বাহিনী ভূমিহীন বাজার ও কেরিংচর দিয়েও একই সাথে আক্রমন করে। মুহুর্মুহু আক্রমনে টিকতে না পেরে রাতের দিকে দলবল নিয়ে নাসির কমাণ্ডার পালিয়ে গেলে মিয়া সিকদার বাহিনী চরের নিয়ন্ত্রন নেয়। চরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ১২ অক্টোবর নঙ্গলিয়ার চরের জনতা বাজার এলাকায় নাসির কমাণ্ডার বাহিনীর সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি হানা দেয় মিয়া সিকদার বাহিনী। একই দিন মালেক ফরাজি, নিজাম, ইসমাইল, বাবর কসাই, বাগরাজ, দীন ইসলামের নেতৃত্বে ভূমিহীনদের নলের চর, নঙ্গলিয়ারচর ও চরবাশারে ভূমিহীনদের ওপর নির্যাতন ও দাগ (প্লট) প্রতি চাঁদা দাবি করা হয়।
১৩ অক্টোবর বিকালে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে চরের দখল পুনরুদ্ধার অভিযানে নামে নাসির কমাণ্ডার বাহিনী। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার পূর্বেই চরের নিয়ন্ত্রন ছেড়ে পালিয়ে যায় মিয়া সিকদার, মুন্সিয়া চোরা ও গিয়াস উদ্দিন বাহিনী। শীর্ষস্থানীয় দস্যুরা পালিয়ে বাঁচলেও সন্দ্বীপ, রামগতি ও হাতিয়ার দক্ষিণের চর থেকে আসা দস্যুদের অনেকেই পথ না চেনায় মিয়া সিকদার বাহিনীর একাধিক সদস্য ধরা পড়ে নাসির বাহিনীর হাতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী জানান, চরবাশার বাজারের দক্ষিনে মেঘনার পাড়ে সাতটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এগুলো কোন বাহিনীর তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
এদিকে ইব্রাহীম মাঝি (৬৫), কামাল উদ্দিন (৩৫), আফছার উদ্দিন (৩৬), রফিক উদ্দিন (৩৫), দুলাল উদ্দিন (৪০), বেলাল মঝি (৩৮) ও মো. খালেক (৪৫) নামের ৭ জনকে নলের চরের আদর্শ গ্রাম থেকে অপরহণের পর হত্যা করে লাশগুম করা হয়ে মর্মে হাতিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় নিহত হিসাবে উল্লেখ করা ইব্রাহিম মাঝির ছেলে নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে ১০৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো কয়েক’শ লোককে আসামী করা হয়।
নলের চরের প্রশাসনিক ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ডাঃ জহির উদ্দিন, ভূমিহীন প্রণতি বালা দাস ও রেজাউল হক জানান, ধান কাটার মওসুম সামনে তাই বাহিনীরা চরে আক্রমন করেছে। সরেজমিনে চরের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মাইলের পর মাইল পাকা ধানক্ষেত। কোন এক অজানা আতংক বিরাজ করছে চরবাসীর মাঝে। অনেকেই নিজেদের মধ্যে হত্যাকান্ডের বিষয়টি বলাবলি করলেও পুলিশ বা সাংবাদিকদের কাছে কেউ তা স্বীকার করছেন না।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানায়, দস্যুদের ধরতে গত সোমবার হাতিয়ার চানন্দি ইউনিয়নের নলেরচর থেকে র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু করা হয়। কোন দস্যুকে গ্রেপ্তার কিংবা অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার না করেই মাএ একদিনের মাথায় অভিযান শেষ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার হারুন-উর-রশিদ হাযারী যায়যায়দিনকে বলেন, অভিযান আপাদত বন্ধ রয়েছে। তবে চরাঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে দস্যু বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। সুবিধাজনক সময়ে আরো বড় ধরণের অভিযান শুরু করা হবে।
- আবু নাছের মঞ্জু