হা বী ব ই ম ন
থমকে গেলো সজীব!
‘কেমন আছেন দাদা?
আমি ভালে। তুমি কেমন আছো?
আপনার লেখা পড়ি, ভালো লাগে।’
এইরকম অনেক কথা বলা হতো। প্রথম দিকে ওর সাথে কাজের কথা কম হতো। পরিচয়ের সূত্রটা ততোটা গাঢ় ছিল না। হাই-হ্যালোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। ধীরে ধীরে ওর সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ট হতে থাকলো। সবসময় ও আমাকে শ্রদ্ধা করতো। এ শ্রদ্ধা আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ। ধীরে ধীরে তার সাথে কাজের কথাও হতো। সেসবের মধ্যে ছিল তার স্বপ্নের কথা। তার তারুণ্যেও কথা। তার ইচ্ছার কথা। সবকিছু পাল্টেয়ে দেয়ার রূপকল্প ওর মধ্যে দেখতাম। ঝুঁকির নেয়ার অদম্য সাহস ওর মধ্যে আমি দেখেছি।
সেসব বহুদিন আগের কথা! কিন্তু তার কথাগুলো এখনও কানের মধ্যে বেজে উঠছে। শিহরণ জাগাচ্ছে। কী আবেগ, কী উচ্ছ্বাস ছিলো তাঁর মধ্যে! আমার মনে পড়ে যখন ছোট্ট শহর নোয়াখালীতে শাহবাগের আদলে গণআন্দোলন গড়ে উঠলো ওখন ওই ছেলেটি লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেরিয়েছে। ওর দেশপ্রেম অন্তরে গ্রোথিত। কী সম্ভাবনাময় একটা ছেলে।
আমি এমন করে এতো সহজে আমি ওর মতোন ভেবেছি কী। বোধহয় পারি নি।
বয়সটা খুব অল্প। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট সে। বয়সের ব্যবধান ১৫-র বেশি তো হবে। কিন্তু তার বিজয়নী প্রাণোচ্ছ্বল! এটা আমাদের বয়সকেও ছাড়িয়ে যেতো। এমন প্রাণোচ্ছ্বল তরুণ চোখ-তরুণ মুখ আমি খুব কম দেখেছি। ও যখন বড় হচ্ছিল, সে সময়টা রাজনীতি-সংস্কৃতির বিরুদ্ধ একটি সময়।
২০১৩ সালে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। যখন পরিচয় হলো তখন মনে হয়নি পরিচয়টা এতো অল্প সময়ে থেমে যাবে, মনে হয়েছে অনেক আগে থেকে চেনা ও। আমার সাথে চেনাটা অনেক পুরানোই মনে হলো।
ছবি তোলার ব্যাপার তার অনেক আগ্রহ। সবার ছবি তোলে সে। নেশাও বলা চলে। ইচ্ছে ছিল এটাকে পেশা হিসেবে নেয়ার। সম্ভবত একটা জাতীয় দৈনিকে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ আরম্ভ করেছিলো। তার ছবি তোলার মধ্যে যে মুন্সিয়ানা ছিল সেগুলো আমাকে ছুঁয়ে যেতো। মুগ্ধ করতো। আমি অভিভূত হতাম।
একসঙ্গে নোয়াখালী প্রেসক্লাব মোড়ে বহুদিন আড্ডা দিয়েছি।
ছবি নিয়ে অনেক কিছু করার স্বপ্ন ছিল। কিছু কাজও শুরু করে ছিল সে। কিন্তু সে আরো কাজ করতে চেয়েছিল। ছোট ছোট প্রোগ্রাম, যেমন ট্রেনিং, গেট-টুগেদার, ফটোওয়ার্ক; এরকম অনেক পরিকল্পনা তার মধ্যে ছিল। মাঝে মাঝে যখন কথা হতো তখন আমার সাথে শেয়ার করতো। তার একটি ভীষণ ইচ্ছা ছিল নোয়াখালীতে একটি ফটোগ্রাফী অ্যাক্সবিশন করা। করেওছিলো। এর আগে কেউ তার মতোন করে এরকম করে ভাবেনি। বন্ধুবর-সহযোদ্ধা নুরুল আলম মাসুদ, আবু নাছের মঞ্জু, জামাল হোসেন বিষাদ ভাইদের সহযোগিতায় এই অ্যাক্সবিশনটা সে পর পর দু-বছর করেছিল। অনেক জেলার ফটোগ্রাফারদের ছবি সেই অ্যাক্সবিশনে স্থান পেয়েছে। প্রতিবছরই সে তার প্রিয় ছোট্ট নোয়াখালীতে এটা করতে চেয়েছিল। কােেরা কারো অসহযোগিতায় এটি সে অব্যাহত রাখতে পারে নি।
ও যখন শুরু করেছিল, অনেকে ভেবেছিল এটা তার নাবালক চিন্তা। না ও দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছের কোনো নাবালকতা নেই। সাহস আর উদ্যম থাকলে সবই সম্ভব। এটি তার ছিল বলেই সে পেরেছে। কোনো কিছুর ঝোঁক একবার উঠলে সে ও্টা করেই ছাড়ে।
নোয়াখালী ঘিরে তার অনেক আশা ছিল। ওর একটা বড় ইচ্ছা ছিল এ নোয়াখালীতে ফটোগ্রাফী নিয়ে একটি অ্যাকাডেমিক কিছু করা। এগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে কথা হতো। ওর চিন্তা আর পরিকল্পনা শুনে আমি খুব রোমাঞ্চিত হতাম। কথাচ্ছলে একবার আমার তোলা কিছু ছবি নিয়ে একটা অ্যাক্সবিশন করতে চেয়েছিল। ওর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম, আমি আগ্রহ দেখাই নি।
স্বপ্নবাজ একটি তরুণ ছেলে। সবার পছন্দের ছেলে। ওকে পছন্দ না করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সজীব চন্দ ওর নাম। ছ্ট্টো শহরের অনেকেই তাকে চিনে। নোয়াখালী শহর নয়, দেশের অনেক মানুষ, যারা ছবি নিয়ে সামান্যতম খোঁজ রাখেন, তারাও তাকে চেনেন। আমাদের অনেকের প্রাণপ্রিয় স্নেহের ছোট ভাই।
কথা নাই, বার্তা নাই, আজ হুট করে সে চলে গেল সবার আড়ালে। এমন কথা ছিল না। বুকের মধ্যে একরাশ পাথর চেপে চলে গেল। যখন ওর মৃত্যুর খ্বর আসে চোখ দুটোর পাতা একসাথ করতে পারি নি। হয়তো অনেক না পাওয়ার চাপা অভিমান ছিল ওর। আমরাই ব্যর্থ ওকে আমরা আমাদের পাশে টেনে রাখতে পারি নি। ওর মৃত্যু আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা কোন অচলায়তন সমাজ এবং রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে আছি। এটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সেই চিত্র, যেখানে সুস্থির চিন্তা এবং বোধের কোনো জায়গা নেই।
যখন সজীবের মৃত্যুর খবরটা জানলাম বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি। স্বজন-হারানো একটা বেদনা চেপে বসেছে। কী অল্প বয়সে তাঁর এভাবে চলে যাওয়া! এটা মেনে নেয়া যায় না। মেনে নেয়াটা আসলে ভীষণ কঠিন। এরকম সতেজ তাজা প্রাণের চলে যাওয়া আমাদের আগামী স্বপ্নময় তারুণ্যে অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জন্যে এটা একটা বড় ধাক্কা।
আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না সজীব আর নেই। বিশ্বাস করতে চাই, অবশ্যই সজীব আছে। সজীব বেঁচে থাকবে আমার ভেতর, আপনার ভেতরে। রোজ সকালে সবুজ পত্রপল্লবে ফোটা জীবন্ত ফুলের মতোন সজীবও আমাদের মাঝে চিরসজীব।
রেড স্যালুট সজীব। যেখানে আছো ভালো থেকো ভাই।
---
২৬ মে ২০১৯
হাবীব ইমন : তরুণ রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি
থমকে গেলো সজীব!
‘কেমন আছেন দাদা?
আমি ভালে। তুমি কেমন আছো?
আপনার লেখা পড়ি, ভালো লাগে।’
এইরকম অনেক কথা বলা হতো। প্রথম দিকে ওর সাথে কাজের কথা কম হতো। পরিচয়ের সূত্রটা ততোটা গাঢ় ছিল না। হাই-হ্যালোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। ধীরে ধীরে ওর সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ট হতে থাকলো। সবসময় ও আমাকে শ্রদ্ধা করতো। এ শ্রদ্ধা আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ। ধীরে ধীরে তার সাথে কাজের কথাও হতো। সেসবের মধ্যে ছিল তার স্বপ্নের কথা। তার তারুণ্যেও কথা। তার ইচ্ছার কথা। সবকিছু পাল্টেয়ে দেয়ার রূপকল্প ওর মধ্যে দেখতাম। ঝুঁকির নেয়ার অদম্য সাহস ওর মধ্যে আমি দেখেছি।
সেসব বহুদিন আগের কথা! কিন্তু তার কথাগুলো এখনও কানের মধ্যে বেজে উঠছে। শিহরণ জাগাচ্ছে। কী আবেগ, কী উচ্ছ্বাস ছিলো তাঁর মধ্যে! আমার মনে পড়ে যখন ছোট্ট শহর নোয়াখালীতে শাহবাগের আদলে গণআন্দোলন গড়ে উঠলো ওখন ওই ছেলেটি লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেরিয়েছে। ওর দেশপ্রেম অন্তরে গ্রোথিত। কী সম্ভাবনাময় একটা ছেলে।
আমি এমন করে এতো সহজে আমি ওর মতোন ভেবেছি কী। বোধহয় পারি নি।
বয়সটা খুব অল্প। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট সে। বয়সের ব্যবধান ১৫-র বেশি তো হবে। কিন্তু তার বিজয়নী প্রাণোচ্ছ্বল! এটা আমাদের বয়সকেও ছাড়িয়ে যেতো। এমন প্রাণোচ্ছ্বল তরুণ চোখ-তরুণ মুখ আমি খুব কম দেখেছি। ও যখন বড় হচ্ছিল, সে সময়টা রাজনীতি-সংস্কৃতির বিরুদ্ধ একটি সময়।
২০১৩ সালে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। যখন পরিচয় হলো তখন মনে হয়নি পরিচয়টা এতো অল্প সময়ে থেমে যাবে, মনে হয়েছে অনেক আগে থেকে চেনা ও। আমার সাথে চেনাটা অনেক পুরানোই মনে হলো।
ছবি তোলার ব্যাপার তার অনেক আগ্রহ। সবার ছবি তোলে সে। নেশাও বলা চলে। ইচ্ছে ছিল এটাকে পেশা হিসেবে নেয়ার। সম্ভবত একটা জাতীয় দৈনিকে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ আরম্ভ করেছিলো। তার ছবি তোলার মধ্যে যে মুন্সিয়ানা ছিল সেগুলো আমাকে ছুঁয়ে যেতো। মুগ্ধ করতো। আমি অভিভূত হতাম।
একসঙ্গে নোয়াখালী প্রেসক্লাব মোড়ে বহুদিন আড্ডা দিয়েছি।
ছবি নিয়ে অনেক কিছু করার স্বপ্ন ছিল। কিছু কাজও শুরু করে ছিল সে। কিন্তু সে আরো কাজ করতে চেয়েছিল। ছোট ছোট প্রোগ্রাম, যেমন ট্রেনিং, গেট-টুগেদার, ফটোওয়ার্ক; এরকম অনেক পরিকল্পনা তার মধ্যে ছিল। মাঝে মাঝে যখন কথা হতো তখন আমার সাথে শেয়ার করতো। তার একটি ভীষণ ইচ্ছা ছিল নোয়াখালীতে একটি ফটোগ্রাফী অ্যাক্সবিশন করা। করেওছিলো। এর আগে কেউ তার মতোন করে এরকম করে ভাবেনি। বন্ধুবর-সহযোদ্ধা নুরুল আলম মাসুদ, আবু নাছের মঞ্জু, জামাল হোসেন বিষাদ ভাইদের সহযোগিতায় এই অ্যাক্সবিশনটা সে পর পর দু-বছর করেছিল। অনেক জেলার ফটোগ্রাফারদের ছবি সেই অ্যাক্সবিশনে স্থান পেয়েছে। প্রতিবছরই সে তার প্রিয় ছোট্ট নোয়াখালীতে এটা করতে চেয়েছিল। কােেরা কারো অসহযোগিতায় এটি সে অব্যাহত রাখতে পারে নি।
ও যখন শুরু করেছিল, অনেকে ভেবেছিল এটা তার নাবালক চিন্তা। না ও দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছের কোনো নাবালকতা নেই। সাহস আর উদ্যম থাকলে সবই সম্ভব। এটি তার ছিল বলেই সে পেরেছে। কোনো কিছুর ঝোঁক একবার উঠলে সে ও্টা করেই ছাড়ে।
নোয়াখালী ঘিরে তার অনেক আশা ছিল। ওর একটা বড় ইচ্ছা ছিল এ নোয়াখালীতে ফটোগ্রাফী নিয়ে একটি অ্যাকাডেমিক কিছু করা। এগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে কথা হতো। ওর চিন্তা আর পরিকল্পনা শুনে আমি খুব রোমাঞ্চিত হতাম। কথাচ্ছলে একবার আমার তোলা কিছু ছবি নিয়ে একটা অ্যাক্সবিশন করতে চেয়েছিল। ওর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম, আমি আগ্রহ দেখাই নি।
স্বপ্নবাজ একটি তরুণ ছেলে। সবার পছন্দের ছেলে। ওকে পছন্দ না করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সজীব চন্দ ওর নাম। ছ্ট্টো শহরের অনেকেই তাকে চিনে। নোয়াখালী শহর নয়, দেশের অনেক মানুষ, যারা ছবি নিয়ে সামান্যতম খোঁজ রাখেন, তারাও তাকে চেনেন। আমাদের অনেকের প্রাণপ্রিয় স্নেহের ছোট ভাই।
কথা নাই, বার্তা নাই, আজ হুট করে সে চলে গেল সবার আড়ালে। এমন কথা ছিল না। বুকের মধ্যে একরাশ পাথর চেপে চলে গেল। যখন ওর মৃত্যুর খ্বর আসে চোখ দুটোর পাতা একসাথ করতে পারি নি। হয়তো অনেক না পাওয়ার চাপা অভিমান ছিল ওর। আমরাই ব্যর্থ ওকে আমরা আমাদের পাশে টেনে রাখতে পারি নি। ওর মৃত্যু আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা কোন অচলায়তন সমাজ এবং রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে আছি। এটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সেই চিত্র, যেখানে সুস্থির চিন্তা এবং বোধের কোনো জায়গা নেই।
যখন সজীবের মৃত্যুর খবরটা জানলাম বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি। স্বজন-হারানো একটা বেদনা চেপে বসেছে। কী অল্প বয়সে তাঁর এভাবে চলে যাওয়া! এটা মেনে নেয়া যায় না। মেনে নেয়াটা আসলে ভীষণ কঠিন। এরকম সতেজ তাজা প্রাণের চলে যাওয়া আমাদের আগামী স্বপ্নময় তারুণ্যে অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জন্যে এটা একটা বড় ধাক্কা।
আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না সজীব আর নেই। বিশ্বাস করতে চাই, অবশ্যই সজীব আছে। সজীব বেঁচে থাকবে আমার ভেতর, আপনার ভেতরে। রোজ সকালে সবুজ পত্রপল্লবে ফোটা জীবন্ত ফুলের মতোন সজীবও আমাদের মাঝে চিরসজীব।
রেড স্যালুট সজীব। যেখানে আছো ভালো থেকো ভাই।
---
২৬ মে ২০১৯
হাবীব ইমন : তরুণ রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি