মো হা ম্ম দ এ হ তে শা মু ল হক
মধুচন্দ্রিমায়
কাজে-অকাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিস্তর। কোথাও অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে, কোথাও একা। এসব অভিজ্ঞতায় কয়েকটি জায়গাকে মনে হয়েছে মধুচন্দ্রিমার জন্য আদর্শ। নিজের সেসব ভ্রমণস্মৃতি নবদম্পতিদের জন্য জাগরূক করেছেন মোহাম্মদ এহতেশামুল হক...
মধুচন্দ্রিমায় বেড়ানোর সংস্কৃতি নতুন নয়। পরস্পরকে জানতে, বুঝতে, কিংবা পুনরাবিষ্কারে এর বিকল্প নেই। দুজনে দুজনার হয়ে ওঠার জন্য। এই ভ্রমণযাপনে সম্পর্কের বরফ গলতে থাকে পরস্পরের গভীর সান্নিধ্যে। সমুদ্র, নদী, হ্রদ, পাহাড়, অরণ্য, উদ্যান ইত্যাদির সৌন্দর্যের মধ্যে থেকে উজাড় করে দেয়া নিজেদের।
মালদ্বীপ
উইলিয়াম-কেট, বেকহ্যাম-পশের মতো অগুনতি সেলিব্রিটির প্রিয় হলিডে ডেস্টিনেশন মালদ্বীপ। সৌভাগ্য এই যে, এটি দক্ষিণ এশিয়াতেই। সরাসরি ফ্লাইটও রয়েছে, ঢাকা থেকে। হানিমুনারদের জন্য আদর্শ। তবে ট্যাঁকের জোর প্রচুর চাই।
মালদ্বীপে গিয়েছি দাপ্তরিক কাজেই। এখানকার শুভ্র বালুচর, স্বচ্ছ নীল জল, বর্ণিল মৎস্যপরিপূর্ণ সমুদ্রধার- অভূতপূর্ব। একাই যেতে হয়েছে। তবে প্রেয়সীকে মিস করেছি প্রতি পলে।
রাজধানী মালে। কিন্তু যখন যাবেন হানিমুনে, মালেতে যাওয়ার কথা ভাববেন না। আপনার মন ভরিয়ে দেয়ার জন্য তৈরি শতাধিক ছোট-বড় রিসোর্ট।
আমরা ছিলাম কুরুম্বায়। আস্ত একেকটা দ্বীপ নিয়ে একটি রিসোর্ট। ছোট-বড় দ্বীপ ১৯৯২টি। আর মানুষের বাস ১৯২টিতে। এয়ারপোর্টেই অভ্যর্থনা জানাবে রিসোর্টের কর্মীর দল। কুর্নিশ করে তুলে নেবে ফেরিতে। কোনো কোনো রিসোর্ট হুলহুলা এয়ারপোর্ট থেকে বেশ দূরে। ওদের রয়েছে ওয়াটার প্লেন, যা শাটল সার্ভিসের মতো।
মালদ্বীপের সৌন্দর্যের বর্ণনায় কালি-কলমের ব্যবহার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। ইচ্ছে করে, পাঠককে সঙ্গে নিয়ে কুরুম্বা রিসোর্টের বিচ রেস্তোরাঁয় বসে কফিতে চুমুক দিই। কিংবা সাঁতরে বেড়াই অগভীর নীলে। হারিয়ে যাই নিঃসীম দিগন্তে। হাতে রুটি নিয়ে লাল-হলুদ-নীল মাছেদের সঙ্গে মেতে উঠি উৎসবে। পাল তুলি সাদা ইয়টে। গা এলাই সৈকতে পেতে রাখা বিলাসবিছানায়। বিশ্রাম নিই ওয়াটার বাংলোতে, যেখানে ভারী কাচের মেঝে। মাছেরা উঁকি দিয়ে অতিথিদের দেখে।
আর নবদম্পতি? বাজি ধরে বলতে পারি, সপ্তাহ খানেকের মধুচন্দ্রিমা উদযাপন এর চেয়ে ভালো হওয়া অসম্ভব। প্রতিটি মুহূর্ত আপনার স্মৃতিতে জেগে থাকবে উজ্জ্বল।
আনন্দের শেষ নেই। স্নরকেলিং, ডাইভিং ইত্যাদি শিখে মেতে উঠুন অনেকের সঙ্গে। হাঁটতে পারেন দ্বীপের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। সৈকত ধরে।
কিংবা কিছুই করবেন না। দুজন শ্বেতশুভ্র বালির বিছানায় শুয়ে থাকবেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দু’জনেই যেন এ সমুদ্রের অধিপতি। ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এর চেয়ে সুখ কোথায়, পৃথিবীতে?
সুইজারল্যান্ড
পকেটের স্বাস্থ্য ভালো হলে মধুচন্দ্রিমার জন্য সুইজারল্যান্ড সেরা গন্তব্য। লন্ডন থেকে ঘণ্টা দেড়েক উড়ে আমরা সকালের ঈষদুষ্ণ রোদে ল্যান্ড করি জুরিখে। আবহাওয়া ভালো থাকলে লিনাট নদীর তীর ঘেঁষে হাত ধরাধরি করে অলস পায়চারি হতে পারে প্রথম কাজ। ট্রামে সুইস আল্পস্। দিনভর জাদুঘর, ফিফা সদর দপ্তর, চিড়িয়াখানা আর নদীতীর দাপিয়ে সন্ধ্যায় ঢুকে পড়তে পারেন কোনো এক নামী রেস্তোরাঁয়। মৃদু ক্যান্ডললাইটে রোম্যান্টিক ডিনার হোক বেশ সময় নিয়ে। জুরিখ নিরাপদ শহর। ভোজ শেষে হেঁটে হোটেলে ফিরবেন। আলো-আঁধারির মাঝে পথচলার এ সময়টুকুও মনে থাকবে সারা জীবন।
পরদিন যেতে পারেন বার্ন ও লুসার্নে। বিশালকায় দেশ নয় সুইজারল্যান্ড। ট্রেনেই এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পাড়ি জমাতে দুই ঘণ্টার বেশি লাগে না। খ্যাতিতে জেনেভা আর জুরিখ এগিয়ে থাকায় অনেকেই জানেন না যে বার্নই রাজধানী। ছোট্ট শহর। এত পরিচ্ছন্ন! এখানেও পদব্রজে ঘুরে বেড়ানোই উত্তম। শপিংয়ের জন্যও মন্দ নয়। নদীতীর ঘেঁষে ঘণ্টা খানেক হাঁটলে মন ভরে যাবে। সঙ্গে মধ্যাহ্নের খাবার। আগ্রহী হলে দ্রাক্ষারস চেখে দেখা, ওয়াটারস্পোর্ট, জাদুঘর সন্দর্শন চলতে পারে।
একটি দিন রাখতে পারেন জেনেভার জন্য। ঘুরে দেখলেন জাতিসংঘ এবং অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর। পাথরখোদাই পথে হাঁটবেন, দৌড়াবেন আবার পথপাশে বসে পড়বেন- সবই মনোদৈহিক আনন্দে টইটম্বুর।
লুসার্ন আর রাটন ফলস ঘুরে আসা যায় একদিন। থুন আর স্পিৎজ ছোট্ট দুটি শহর। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াতে পারেন। ক্লান্ত হলে আবার উঠে পড়বেন ট্রেনে। এমনি করে এক বিকেলে আমরা পৌঁছাই ইন্টারলাকেনে। বার্ন থেকে রেলযোগে। ঘণ্টা খানেকের পথ। দু’ধারে ঘনশ্যাম বনানী, তুষারশোভিত আল্পস্ আর থুন হ্রদের সবুজ জলরাশি। ছবির মতো সুন্দর একেই বলে!
সুইজারল্যান্ডের সেরা আকর্ষণও এই ইন্টারলাকেন। মধুচন্দ্রিমার জন্য আদর্শ। থুন ও ব্রিয়েনজ নামে দুই হ্রদের মাঝখানে বলে জায়গাটির নাম হয়েছে ইন্টারলাকেন। সঙ্গে আল্পস পর্বতশ্রেণী। তিন শীর্ষ- আটগার, মন্শ ও ইউংফ্রাউ। পর্বত, বনানী আর জলাধার নিয়ে এ এক স্বপ্নের জগৎ। দিনভর ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে মাউন্টেন রেল, কেবল কার আর প্যারাগ্লাইডিং। কিন্তু প্রাপ্তি বেশি। সময় লাগে কম।
প্যারিস, ফ্রান্স
প্যারিস সিটি অব লাভ। হানিমুনে প্যারিসে যাবেন না, তো যাবেন কোথায়? আইফেল টাওয়ার বেয়ে উঠে জম্পেশ ভোজ, সাইন নদীতে নৌকাভ্রমণ, বিখ্যাত শঁজে লিজেতে হেঁটে চলা আর শপিং, লুভ জাদুঘরে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা মোনালিসার রহস্যময় হাসির দিকে, আর ভার্সাই প্রাসাদের চাকচিক্যে ঢুকে যাওয়া- প্যারিস সত্যিই অতুলনীয়।
সপ্তাহ খানেক সময় নিন। বেশি হলে আরও ভালো। প্যারিসের জন্য পরামর্শ, শারীরিকভাবে ফিট যদি হয়ে থাকেন, হাঁটুন। পর্যটকদের আরও সুবিধা দিতে এ বছরের শেষ নাগাদ শহরের কিছু অংশ গাড়িমুক্ত হবে।
হাঁটা শুরু হতে পারে পশ্চিম থেকে পূর্বে। আর্ক দো ত্রিওম্ফ থেকে শুরু। শঁজে লিজের শীর্ষ এই বিজয়তোরণ। এখান থেকে লা কনকর্ড স্কয়ারের দিকে হাঁটতে থাকুন। পথের দুই পাশে শ্যানেল, ডিওর, ইভস সাঁ লোর, ল’রিয়াল- এসব ফ্যাশন আর বিউটি জায়ান্টের আউটলেট আপনাদের দৃষ্টি তো বটেই, গতিও আটকাবে। প্রিয়জনের মন রক্ষায় হয়তো ফতুর হওয়ার জোগাড় হবে। তবে এসব ব্র্যান্ডের জিনিস তাদের সদর দপ্তর থেকে সংগ্রহ করার আনন্দটাই বা কম কিসের?
শঁজে লিজের অন্য প্রান্তে পতিত প্যালেস ও গ্রাঁ প্যালেস। পার হলেই প্লেস দো লা কনকর্ড। জায়গাটার মাহাত্ম্য অনেক। এখানে দাঁড়িয়ে যেদিকেই তাকাবেন- দেখবেন প্যারিসের একেকটি অমূল্য স্থাপনা। সামনে তুইলেরিয়াস। পেছনে শঁজে লিজে আর আর্ক দো ত্রিওম্ফ। ডানে আইফেল টাওয়ার এবং মিউজি দ্য’ওরসে। বাঁয়ে ম্যাডেলিন গির্জা। আরেকটু সামনে লুভ আর নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। এখন নিশ্চয় আপনি সাটন নদীর পাশ ঘেঁষে হাঁটছেন।
এসব স্পটের যে-কোনোটিতে চার-ছয় ঘণ্টা কি পুরো দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। আইফেল টাওয়ারে সময় নিয়ে যাওয়া ভালো। উপরে ওঠার জন্য দীর্ঘ কিউ হয়। কম হলেও ঘণ্টা দুয়েক হাতে রাখতে হবে। তরতর করে উঠে যাবেন বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় টাওয়ারে।
তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া
স্পিরিট অব তাসমানিয়া; বিশাল ত্রুজশিপ। মেলবোর্ন থেকে ছেড়ে যায় সন্ধ্যায়। ভোরে পৌঁছাবে ডেভনপোর্ট। তাসমানিয়ায় পাড়ি জমানোর সেরা আয়োজন এই জাহাজ।
ভালো হয়, যদি নিজে ড্রাইভ করেন। দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়ুন। ডেভনপোর্ট থেকে যেতে পারেন লঞ্চ স্টেশন। ঘণ্টা দুয়েকের পথ। দিগন্তজোড়া ওয়াইনারির মাঝ দিয়ে কান্ট্রি মিউজিক শুনতে শুনতে হারিয়ে যাবেন। উত্তরাংশের সবচেয়ে বড় শহর। তামার নদীতে চলতে পারে বোট ক্রুজ। মধ্যাহ্নের খাবারের পসরা সাজিয়ে রয়েছে অনেক রেস্তোরাঁ। সাউথ এস্ক নদীর এক প্রান্তে অবস্থান। অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। পাথুরে পাহাড়ের মাঝে সযত্নে তৈরি বোর্ডওয়াক। প্রবেশমুখ থেকে প্রায় মিনিট চল্লিশ হাঁটার পর মূল জায়গা। গিরিখাত। চারপাশে পাহাড়। নিচে শান্ত জলাধার। কেবল কারে করে পাড়ি দিতে পারেন এক পর্বতের শীর্ষ থেকে অন্যটিতে।
লঞ্চেস্টন থেকে পশ্চিম উপকূল ধরে ড্রাইভ করবেন। পথে যেখানে খুশি রাত কাটাবেন। ছোট শহর আছে অনেক। অন্য প্রান্তে হোবার্ট। ডারওয়েন্ট নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শহর। এক প্রান্তে মাউন্ট ওয়েলিংটন। শহরের যেকোনো পয়েন্ট থেকে চোখে পড়ে। সিটি সেন্টার থেকে ঘণ্টা খানেক লাগে যেতে।
পর্বতশীর্ষ তুষারাচ্ছাদিতই থাকে। গ্রীষ্মেও, কখনো কখনো। ওয়েলিংটন পার্ক নিয়ে বলা হয়, কোনো কোনো দিন আপনি স্পষ্ট দেখবেন ভাসমান সাগর, ন্যাশনাল পার্কের জীবজন্তু, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। আবার কপাল ভালো না হলে নিজের জুতাজোড়াও দেখবেন না। এমন ভারী কুয়াশা!
আমরা যেদিন যাই, আকাশ ছিল পরিষ্কার। বিকেলের দিকে পৌঁছাই। স্প্রিংস এবং শ্যালে হয়ে পিনাকল রোড ধরে পৌঁছাই শীর্ষে। পর্যটকরা ভালোভাবে যেন দেখতে পারেন, তার নানা আয়োজন। স্থানে স্থানে রাখা দূরবীন। চারপাশের অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করছিলাম। আচমকা ঝুপ করে নেমে যায় সন্ধ্যা। তার আগের আধ ঘণ্টায় এক স্বর্গীয় আলো নেমে আসে পৃথিবীতে। লালচে আভা! কী তার রূপ! পাথররাজিতে লাল-কমলা ছোপ। চারদিকের দৃশ্য বদলে যাচ্ছে। অশরীরী আত্মার উপস্থিতি যেন টের পাচ্ছি। ভোলার নয় সেই দৃশ্য!
- মোহাম্মদ এহতেশামুল হক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব
- ছবি: লেখক