আবু নাছের মঞ্জুঃ
নোয়াখালীর উপকূলীয় চরে খরা ও লবনাক্ততার কারনে পতিত জমিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি তিসি-১ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে কৃষক। কম খরচে তিসির অধিক ফলন ও বাজার মূল্য পাওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মাঝে নতুন আশার আলো জাগিয়েছে। সংশ্লিস্টরা মনে করছেন-আগ্রহী কৃষকদেরকে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত প্রনোদনা দেয়া গেলে পতিত জমিতে তিসি চাষ নবদিগন্ত সূচিত করবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) হিসেবে, উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীতে খরা ও লবণাক্ততার কারনে রবি মৌসুমে ৭৫ হাজার হেক্টর জমি প্রতি বছর পতিত থাকে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কিল্লারচর, গাংচিল, হোসেনপুর এবং সুর্বণচর উপজেলার চরর্ক্লাক, চর তোরাবআলীতে বর্ষা মৌসুমে বেড়ি বাঁধের বাইরের ফসলী জমিতে জোয়ারের পানির অনুপ্রবেশের ফলে চাষাবাদ চরমভাবে ব্যাহত হয়। এ সব এলাকায় বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় পর উঁচুমাত্রায় লবনাক্ততার কারনে খুব সীমিত আকারে রবি ফসলের চাষ হয়। বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের মাঠভিত্তিক গবেষণায় দেখা যায়, বারি তিসি-১ বীজ গজানো থেকে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত ২-১২ডি এস/মি মাত্রার লবনাক্ততা সহনশীল।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আমির ফয়সল জানান, যেসব জমিতে লবণাক্ততার প্রকোপ মার্চ-এপ্রিলে মাসে বেশি (১২ ডিসি/মি. বেশী) থাকে সেইসব জমিতে সাথী ফসল হিসাবে তিসি চাষ করা উত্তম। বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খরাপ্রবন ও লবণাক্ত এলাকার জন্য টেকসই ফসল ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন প্রকল্পের অধীনে এসব চরে ২০১০ সাল থেকে কৃষকদেরকে তিসি চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আগ্রহী কৃষকদেরকে বিনামূল্যে উন্নত জাতের বারি তিসি-১ বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়। যার কারণে এবার ৪৫০ হেক্টর জমিতে তিসি চাষ হয়। পতিত জমিতে কম খরচে তিষি চাষে ভালো ফলন ও উৎপাদিত ফসলের ভালো বাজার মূল্য পাওয়াতে কৃষকরা এতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। কোম্পানীগঞ্জের চরযাত্রা, গাঙ্গচিল, হোসেনপুরের এক সময়য়ের পতিত জমিগুলোতে তিসির সোনালী ফসল যে কারো নজর কাড়বে।
কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী ইউনিয়নের গাঙ্গচিলের জাফর উল্লা জানান, বেড়িবাঁধ না থাকাতে লবনাক্ত পানির কারণে জমিতে কোন ফসল হয় না। এখন এ সব জমিতে লবন সহিষ্ণু তিসি চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন। তিনি ২০১১ সালে এক একর জমিতে তিসি চাষ করেন। এবার ১২ একর জমিতে বারি তিসি-১ চাষ করেন। এতে একর প্রতি খরচ হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ফসল কাটা হবে। ফলন ভালো হওয়ায় আশা করছেন খরচ বাদ দিয়ে একর প্রতি ১৫ হাজার টাকার মতো লাভ হবে।
চরযাত্রার কৃষক জামসেদ জানান, তার চার একর জমি আমন ধান কাটার পর অনাবাদী পড়ে থাকতো। আমনের ফলনের তেমন একটা লাভের মুখ দেখতেন না। গত বছর বছর কৃষি গবেষণা বিভাগ থেকে বারি তিসি-১ এর বীজ নিয়ে চাষ তিনি। ফলন ভালো ফলন পাওয়াতে এবার তিসি চাষ করেছেন তিনি। জামসেদের দেখাদেখি এলাকার অন্য কৃষকরাও পতিত জমিতে তিসি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠে।
তিসি চাষে কৃষকদের এই সাফল্যে খুশি জনপ্রতিনিধিরাও। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল জানান, চরের পতিত জমিগুলো তিসি চাষেরর আওয়াত আসালে কৃষিতে বেকারত্ব দূর হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে কৃষক।
বারির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরীর জানান, নোয়াখালীর চরাঞ্চলের জমি একফসলী হওয়ায় রবি মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের কোন কাজ থাকে না। পতিত জমিতে তিসি চাষের আওতায় আসলে বেকারত্ব নিরসন ও কৃষক পরিবারগুলোতে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। এতে করে তাদের মধ্যে হতাশা জনিত কারণে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতাও হ্রাস করা যাবে। সর্বোপরি পতিত জমি ব্যবহারের মাধ্যমে শস্যের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব হবে।
সংশ্লিস্টরা জানান, উন্নত বিশ্বে তিসির বহুবিধ ব্যবহার হয় যেমন-বীজ থেকে রং, বার্নিশ, ছাপাখানার কালি এবং কান্ড ও শাখা-প্রশাখা থেকে প্রস্তুতকৃত আঁশ থেকে লিনেন জাতীয় কাপড়, কাগজসহ অন্যান্য অনেক দ্রব্য তৈরী হয়। এছাড়াও ওমেগা-৩ এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী লিগনিনের ভালো উৎস হওয়ায় মানুষের খাদ্য তালিকায় তিসি তৈলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিসির আবাদ এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি তন্তু উৎপাদনকারী জাত নিয়ে কার্যকরী গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপন করা হলে রপ্তানিমুখী শিল্পে নতুন দিগন্ত উম্মেচিত হবে।