সর্বশেষ

কীসের শিক্ষা, কীসের কী!

হা বী ব    ই ম ন

কীসের শিক্ষা, কীসের কী!

হাবীব ইমন
নোয়াখালীর একটি শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যাপীঠ অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপর এই ঘটনার পর ভেতরকার অনুভব শক্তি যেন স্তব্ধ হয়ে আসছে। এ কোন বাংলাদেশ? পিতৃতুল্য শিক্ষকের উপর এ কোন ধরণের হামলা! এতো উগ্রতা কেন?

আমার জন্মকাল থেকে এখন পর্যন্ত মাইজদীর সাথে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কয়েক বছর হলো শারীরিকভাবে এ শহর ছেড়ে এসেছি। মনের জায়গায় আমার সবুজ-শ্যামল নোয়াখালী ত্যাগ করতে পারি নি। মাইজদী শহরের মধ্যে থাকলেও তার আশপাশের নানা গ্রামে, ছোট একটি রেল স্টেশনে নেমে আরও ছোট সব জনবসতিতে হেঁটে ঘুরে ঘুরে পার হয়েছে আমার জীবনের ৩০টা বছর।

অনেকগুলো সময় দেখেছি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দেখেছি, সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন, বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। দেখেছি বিভিন্ন উপদলে বিভক্তদের অস্ত্র মহড়া, পেশিশক্তির তোড়জোড় দেখেছি। কিন্তু কখনও, কোনদিন, এইসব সমাজবিরোধী সন্ত্রাসীদের হাতে কোন শিক্ষক লাঞ্চিত হতে দেখিনি। 

একবার নোয়াখালী সরকারি কলেজ বর্তমান স্থানান্তরের সময় দেয়াল-লিখন করেছিল পূর্ববর্তী স্থানের বাসিন্দারা : ‘জলিল তুই কবে যাবি।’ যাঁকে নিয়ে এ দেয়াল লিখন, তিনি নোয়াখালী অঞ্চলের কৃতিমান শিক্ষাবিদ, নোয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রয়াত প্রফেসর আবদুল জলিল। এটি গত শতাব্দীর নব্বই দশকের কথা।  

ছেড়ে এসেছি সেই ছোট্ট নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদী শহর, কয়েক বছর হলো। আর হঠাৎ, হঠাৎই এক ঘটনা সেখানে-যার কোন বর্ণনা, কোনও অভিধা, কোন বিশ্লেষণ দেয়া অসম্ভব। অসম্ভব। নারকীয়! পৈশাচিক!! এসব কথায় নিতান্তই ছোট মনে হয়। আমার ভিতরকার অনুভব শক্তি যেন স্তব্ধ হয়ে আসে। সে কিছু ভাবতে চাইছে না। কেননা ভাবতে গেলে, কিংবা অনুভব করলেই যন্ত্রণা। তার চাইতে পালানো ভালো। নিজের কাছ থেকে পালানো।

কয়েকটি অনলাইনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুকে ছেয়ে গেছে এ খবরটি। বেশ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেখানে। নোয়াখালী শহরের ও এই স্কুলের প্রাক্তণ ছাত্রদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বেশ হইচই হচ্ছে। প্রাক্তণ ছাত্রদের কাছ থেকে উদ্বেগ শুনতে পাচ্ছি। কিছুক্ষণ আগে পাওয়া এ সংবাদটি আমাকে বিচলিত করেছে। 
সংবাদটি হলো : ‘নোয়াখালীতে স্কুলে হামলা, তিন শিক্ষক আহত।’ আজ (২৪ মার্চ) বেলা তিনটায় জেলা শহর মাইজদীর শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যাপীঠ অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের উপর হামলা করেছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী। এ স্কুলটি ভুলুয়ার জমিদার অরুন চন্দ্র সিংহের নামানুসারে ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নোয়াখালীর বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই স্কুলের ছাত্র। যাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ পর্যায়ে আছেন। 

ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, এই বাজিগর বাড়ির লোকজন ভালো না। এদের নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তারা মাদক কেনা-বেচা, চাঁদাবাজিসহ শহরের নানারকম অপরাধের সাথে জড়িত। এলাকার সবাই জানে, পুলিশেরও অজানা নয়, বাজিগর বাড়ির লোকজন ক্রাইম করে। তবুও সমাজের ভেতর, স্থানীয়দের মধ্যে এরা বেশ প্রভাব বিস্তার করে চলে। একটি ভীতিকর পরিবেশ ওরা তৈরি করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ ওদের ভয়ে একত্রিত হতে পারে না। কেননা ওদেরকে কিছু ব্যক্তি প্রশ্রয় দিচ্ছে। যারা নিজেদের প্রয়োজনে এদেরকে ব্যবহার করছে। পুলিশও তাদের অপকর্মের সহযোগিতা করে, ফলে এদের বিরুদ্ধে পুলিশ অ্যাকশনে যেতে পারে না। কেননা পুলিশের কাজ শুধু অপরাধীদের ধরা নয়, অপরাধ ঘটার মতো পরিবেশ সৃষ্টি না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।   

মাইজদী বাজারে নোয়াখালীর অনেক প্রভাবশালী মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে কয়েকজন আছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা। আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতির বাসা মাইজদী বাজারের অদূরে নোয়াখালী সরকারি কলেজের পুরাতন ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায়। এছাড়া কয়েকটি পুলিশিং ও সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন আছে। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এইসব সংগঠন অনেক কাজ করছেন বলে শুনি। এলাকার কাউন্সিল আছেন, তিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ। বাজিগর বাড়ির বাসিন্ধা। তিনি এ স্কুলের প্রাক্তণ ছাত্র। আমি অপেক্ষা করছি, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

যে স্কুলটিতে এ ঘটনাটি ঘটেছে, সেই স্কুলের ছাত্র নই আমি। তবে তার সংলগ্ন অরুণ চন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। কেবলমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এ স্কুলটির প্রতি আমার টান একটু বেশি। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসে দিনে-দুপুরে শিক্ষকদের উপর কয়েকজন বখাটের ছেলেদের প্রথমে শাসিয়ে, পরে হামলা করার সাহস হয় কীভাবে। যারা হামলা করেছেন তারা হয়তো কেউ কেউ ঐ তিনজন শিক্ষকের ছাত্র হবেন, আমি ঠিক জানি না। মানুষ কোন জায়গায় পৌছেছে যে, এই কাজ তার দ্বারা সম্ভব হয়। কোন প্রতিশোধস্পৃহা কোন ক্রোধ এই ধরণের ভায়োলেন্স ঘটাতে পারে! আমার ধারণায়, আমার ভাবনায় আসে না। আমি আউট অফ ডেট হয়ে আছি।

কোথায় আছি আমরা? মানুষ গড়ার কারিগরদের কি কোন মূল্য নেই আমাদের দেশে? শিক্ষকরা এভাবেই নগ্ন হামলার শিকার হবেন? শিক্ষকরা কি এভাবে লাঞ্চিত হবেন? শিক্ষার জন্য তাদের যে নিবেদন তা কেউ শোধ করতে পারবে না। যে শিক্ষকদের কারণে রাষ্ট্রের ভিত্তি তথা সুনাগরিক টিকে আছে, তারা আজন্ম অবহেলা, লাঞ্চনার শিকার। শিক্ষক শুধু একজন শিক্ষক-ই নয় শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে নিকট অভিভাবক, পিতা বটে। আজ সেইসব শিক্ষকরা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তাদের অপরাধ, পিন্টু ভট্টাচার্য্য স্কুলচলাকালিন সময়ে সন্ত্রাসীদেরকে স্কুলের মাঠে খেলতে নিষেধ করেছিলেন। 

স্কুলের প্রতি এমন দায়িত্বসুলভ আচরণের জন্যই কি তাদের উপর এভাবে হামলা করতে হবে? যাদের উপর হামলা করা হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষ। বৃত্তিনিষ্ট। আহত তিনজন শিক্ষককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আমার সরাসরি শিক্ষক না হলেও এঁরা আমার শিক্ষক। তারা খুব স্বল্প ও মিষ্টভাষী। পিন্টু ভট্টাচার্য্য আমার বন্ধুর বড় ভাই। আজকে যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, আগামীকাল আমার উপর ঘটতে পারে। সম্মানিত শিক্ষকদের ভেতর যে আর্তনাদ, এই আর্তনাদ তাদের একা নয়, আমাদেরও। আমি ভাবি, কীভাবে সমস্ত পরিপার্শ্ব বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। কীভাবে এই বদলটা ঘটছে? কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। অথবা এও হতে পারে, আর বুঝতে চাই না আমি। এক ধরণের বিরাট ব্যর্থতার জ্বালা ভেতরটাকে পুড়ে যাচ্ছে। খানিক চেঁচাবো, চিৎকার করবো! কেউ শোনে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবো? বসে পড়ছি। রাস্তার ধারে। ঘরে ঢুকে গেছি। গাছপালা দেখছি। পূর্নিমা দেখছি। আমি তাকাতে পারছি না।
হ্যাঁ, আমিও তো সেই অপরাধী একজন!

বাঘের গর্ভে সবসময় বাঘ জন্মায়, সাপ জন্ম দেয় সাপের। মানুষ একমাত্র প্রাণী যে মানুষের জন্ম দেয়, আবার দানবের জন্মও দেয়। দানবদের কর্মকান্ড দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি, কারণ এই দানবেরা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অংশ, এরা ভিনগ্রহ থেকে আসেনি। আমরা ক্রমশঃ দানবদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছি। কীসের শিক্ষা, কীসের কী! শিক্ষকরা জাতির বিবেক, এইসব কথার দিন বুঝি শেষ হয়ে আসছে। ভুলে যাওয়াই বোধহয় এখন সঠিক। সব গোল্লায় যাক তো! 
আমাদের শিক্ষকদের তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ই হোক, উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় হোক বা বিশ্ববিদ্যালয় হোক, অনেক রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেটা অস্বীকার করা যাবে না। সেই দুর্বলতার অনেকগুলোর জন্য আমরা দায়ী। কিন্তু তারপরেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমাদের শিক্ষকরা দেশকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। সোনা-রূপা কিংবা তেল-গ্যাসের খনি নয়, পৃথিবীর সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান! ব্যাপারটা শিক্ষকদের জন্য গৌরবের। তারা পৃথিবীতে সম্পদ তৈরি করে যাচ্ছে।

সেই শিক্ষকরা যখন কতিপয় সন্ত্রাসীদের হাতে লাঞ্চিত হন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শিকার হন, তখন ব্যাপারটা কত দুবোর্ধ্য লাগে, সেটা কি কেউ ভেবে দেখেছে?

---
হাবীব ইমন.
কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক
ঢাকা ।
Emonn.habib@gmail.com

লোকসংবাদ | Loksangbad | The First Bangla Online Newspaper from Noakhali সাজসজ্জা করেছেন মুকুল | কপিরাইট © ২০২০ | লোকসংবাদ | ব্লগার

Bim থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.