আবু নাছের মঞ্জু, নোয়াখালী:
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নোয়াখালীবাসীর কাছে চির স্মরণীয় নাম শহীদ অহিদুর রহমান অদুদ। ২১ নভেম্বর রাজাকার মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে আত্মদান করেন তিনি। প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে নতুন প্রজম্মের কাছে অজানা রয়ে গেছে তাঁর বীরত্ব গাঁথা। সরকারিভাবে নির্মিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফলকে স্থান পায়নি এই বীরের নাম। এনিয়ে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা। অহিদুর রহমান অদুদের জন্ম ১৯৪৯ সালে ২৮ জানুয়ারি নোয়াখালীর জেলা শহরের ল’ইয়ার্স কলোনিতে। তাঁর পিতা মুজিবুর রহমান মোক্তার ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার গণপরিষদ সদস্য এবং ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ছিলেন। পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অহিদুর রহমান ছাত্র অবস্থায় বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা, ছাত্রসমাজের ১১ দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যুঙ্খানে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ঢাকসু) সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর ১২ নভেম্বরের প্রলংকরী ঘূণিঝড়ে নোয়াখালী উপকূলে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তখন অদুদ সহ ঢাকসুর একটি প্রতিনিধি দল দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অহিদুর রহমান অদুদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ইসতেহার পাঠ অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। ২৫ মার্চের পর ভারতের উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুবকদেরকে সংগঠিত করার জন্যে নোয়াখালী ফিরে আসেন অহিদুর রহমান অদুদ। তিনি ছিলেন অবিভক্ত সদর থানা বিএলএল অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কবিরহাট, চাপরাশিরহাট, কালামুন্সি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিজানর রহমান জানান, ২১ নভেম্বর ভোরাতে সদর থানা বিএলএল অধিনায়ক অহিদুর রহমান অদুদ ও কোম্পানীগঞ্জ থানা বিএলএফ অধিনায়ক বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধরা কোম্পানীগঞ্জের তালমোহাম্মদের হাট রাজাকার মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ সময় ওই ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকার মিলিশিয়া বাহিনীর অনেকে হতাহন হয়, প্রাণভয়ে অনেকে পালিয়ে যায়। ততক্ষণে সূর্যের আলো দেখা দিলে গোপন স্থান থেকে শত্রুপক্ষের গুলি অদুদের বুকে এসে লাগে। মুহুর্তেই মৃত্যুকোলে ডলে পড়েন তিনি। পরে সহযোদ্ধারা অদুদের মরদেহ স্থানীয় বাসিন্দা জনৈক আবদুর রব জাপানীর জিম্মায় লুকিয়ে রাখেন। মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেলে রাজাকাররা অনেক নির্যাতনের পরও অদুদের লাশের সন্ধান নিতে পারেনি রাজাকারা। পরদিন লামচিপ্রসাদ তাকিয়া মসজিদের পাশে এই বীর যোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়।
সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে রণাঙ্গণে অহিদুর রহমানের সহযোদ্ধা কবি এনাম আহসান বলেন, বিএলএফ সদর কমান্ডার অহিদুর রহমান ও কোম্পানীগঞ্জ থানা কমান্ডার ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা চারটি দলে ভাগ হয়ে রাজাকার মিলিশিয়া ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনা করি। ভোর পর্যন্ত অনেক রাজাকার মিলিশিয়া হতাহত হয়। সূর্য উঠে গেলে আমরা অপরারেশন সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নি। এ সময় শত্রুপক্ষের একটি গুলি অদুদের নাভিমূলে বিদ্ধ হয়। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ও চুন্নুর কোলে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
এ ব্যাপারে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা হকসবা বলেন, অদুদ ভাই মারা যাওয়ার পরে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধরা এসে জাপানি সাব ও শেখ আহাম্মদ মিয়ার কাছে লাশটা রেখে যান। এরপর একটি গড়ের মধ্যে লাশটা কচুরি ফানা দিয়ে লুকয়ে রাখার হয়। মুক্তিযোদ্ধা চলে যাওয়ার পর রাজাকাররা এসে লাশের সন্ধান দেয়ার জন্য তাদের দুজনকে অনেক নির্যাতন করে। তারপরও উনারা লাশের সন্ধান দেননি। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন বলেন, অনেক কষ্টে লাশ উদ্ধার করে দাফন কাপন সম্পন্ন করি।
স্বাধীনতার পর রাজাকার মিলিশিয়া ক্যাম্পের স্থানে প্রতিষ্ঠা করা হয় বামনী কলেজ। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে কলেজের সামনের সড়কটিকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অদুদ সড়ক নামকরণ করা হয়। তবে, জেলা সদরে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলকে স্থান পায়নি এই বীরের নাম। এনিয়ে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা। সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিজানুর রহমান বলেন, তালমোহাম্মদের হাট এলাকার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদেরকে অকল্পনীয় সহযোগীতা করেছে। অদুদের লাশ যখন আনা হয় তখন মানুষের চোখে পানি আজো আমদের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। অদুদের মতো একজন বীরের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলকে নেই। আমরা একবার ডিসির সাথে এনিয়ে সংগ্রাম করার পর রং দিয়ে অস্থায়ীভাবে তার নাম লেখা হয়। কিন্তু এখন তা মুছে গেছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তার নাম স্মৃতিফলকে স্থয়ীভাবে লিপিবদ্ধ না করা হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।
লামচিপ্রসাদ তাকিয়া বাজারে প্রতিষ্ঠিত শহীদ অহিদুর রহমান অদুদ স্মৃতি সংসদ সরকারিভাবে এই বীরের স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের দাবিতে মানববন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। সংগঠনের সভাপতি শাহ আলম বলেন, শহীদ অহিদুর রহমান অদুদ আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। তার বীরত্বগাঁথা নতুন প্রজম্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আমরা এই স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের দাবি হচ্ছে সরকারিভাবে যেন এখানে একটা পাঠাকার, মিলনায়তন ও স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়। এতে করে নতুন প্রজম্ম তার বীরত্ব সম্পর্কে জানতে পারবে। শহীদ অহিদুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বামনী কলেজকে তার নামে নামকরণের দাবি জানান তিনি। এ ব্যপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃস্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস বলেন, পাক মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন অহিদুর রহমান অদুদ। তার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফলকে স্থায়ীভাবে স্থাপন করার বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার স্মৃতি রক্ষার্থে কলেজের নামকরণ, পাঠাগার স্থাপনের বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নেব।
- আবু নাছের মঞ্জু