দেবার্ঘ্য মুখার্জী
আতর
মনোহর পুকুর রোডের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেই প্রকান্ড দত্ত বাড়িটা চোখে পড়ে, দরজার বাইরে দুই দিকে দুটো আইসা বড়ো সিংহ লাগানো আছে | বড়ো দরজার গেটটা খোলা ছিল বলে সোজা ভিতরে বাইক নিয়ে ঢুকে এল শ্রীকান্ত | একজন ভৃত্য শ্রেণীর লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো কাকে চান? শ্রীকান্ত মাথার থেকে হেলমেটটা খুলে হাসি মুখে বললো, রমণীবাবু বাড়ি আছেনতো? আমি ওনার কাছেই এসেছি,কথাটা শেষ হতে দিলো না লোকটা, বললো বাবু কারো সাথে দেখা করেননাতো আজকাল |
আমি প্রেস থেকে আসছি, ওনাকে গিয়ে বোলো, জানায় শ্রীকান্ত
আছা বলছিক্ষনে, লোকটা এগিয়ে যাচ্ছিলো, শ্রীকান্ত ডেকে তার প্রেস কার্ডটা দিয়ে বললো, ওনাকে এটা দেখাও, উনি বুঝতে পারবেন | লোকটি কার্ডটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলো | কিছু পরে এসে বললো, আসুন আমার সাথে, বাবু আসছেন | লোকটির পিছু পিছু শ্রীকান্ত এসে ঢুকলো, প্রকান্ড একটি হল ঘরে | বেশ সাবেকি আমলের ফার্নিচার দিয়ে সাজানো গোছানো ঘরটি | সামনের বেতের চেয়ারে শ্রীকান্তকে বসতে বলে, লোকটি চলে গেল | চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো শ্রীকান্ত | একটু দূরে সুন্দর কাঠের কাজ করা একটি দেওয়াল ঘড়ি আর ঠিক তার নিচেই কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা নানা পুরস্কার | সেই দিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল শ্রীকান্ত |
শ্রীকান্ত চাকরি করে কলকাতার একটি প্রকাশনী সংস্থাতে | বেশ বড়ো কোম্পানি, তাদের নিউসপেপার , ম্যাগাজিন, বুক পাবলিকেশন সবই হয় | কলকাতার বাছাই করা প্রকাশনী সংস্থাগুলির মধ্যে এককথায় শীর্ষে বসে আছে এরা | শ্রীকান্তর এটা তিন নম্বর চাকরি, এর আগে বেশ কয়েক বছর ছোট বড়ো কোম্পানির ধাপ পেরিয়ে এখানে এসেছে সে | চাকরিটি মন্দ না, মাইনেপত্তর বেশ ভালো, বস ভালো, কাজের চাপও খুব বেশি নেই | তবে শ্রীকান্ত হতে চেয়েছিলো একজন পেশাদারি লেখক, কিন্তু সেটা সে হতে পারেনি, তাই মাঝে মাঝেই বড়ো লেখকদের ইন্টারভিউ নিতে গেলেই বুকটা চীন চীন করে ওঠে তার | আজ সে এসেছে প্রখ্যাত লেখক শ্রী রমণী মোহন দত্তর কাছে দেখা করতে | রমণী বাবুর খ্যাতি দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে | রহস্য ও ভৌতিক গল্প এবং উপন্যাস লিখিয়েদের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ট মনে করা হয় ওনাকে | বম্কিমচন্দ্র শরৎ চাটুজ্জে আর সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য চর্চাকে যে মান বাঙালি পাঠক আমৃত্যু দিয়ে এসেছে, তা রহস্য উপন্যাস লেখককে বাঙালিরা কোনো দিনও দিতে শেখেনি, কিন্তু মজার কথা হলো আগাথা কৃষ্টি , অর্থার কোনান ডয়েলের মতো লেখকের লেখা সারা বিশ্বের মানুষ এক অতি উন্নত মানের সাহিত্য হিসাবে গণ্য করে | তবে আমাদের রমণী বাবু সেই নাকউঁচু বাঙালিকেও কিন্তু বাধ্য করেছেন রহস্য গল্পকারকে সম্মান দিতে | শ্রীকান্ত ওনার বহু লেখা পড়েছে | ওনার জাতটাই আলাদা, কোনো ভাবে আর পাঁচটা বাঙালি লেখকের ওই জোলো জোলো ভুতপেত্নী আর রহস্য কাহিনী উনি লেখেন না | ওনার লেখা অনেক বেশি বাস্তবমুখী |
হঠাৎই গলা কাশার আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে তাকালো শ্রীকান্ত, আর খেয়াল করলো নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন আলমারিটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে. ততক্ষনে ভিতরের দিকের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন রমণী মোহন দত্ত | একটু অপ্রস্তুত হয়েই নিজেকে সামলে নিলো শ্রীকান্ত | এগিয়ে এসে রমণী বাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই , থাক থাক করে উঠলেন রমণী বাবু, বললেন বস, সামনের সোফাতে বসে বাম হাতে শ্রীকান্তর কার্ডটা দেখতে দেখতে বললেন, সোমনাথ তাহলে তোমাকে পাঠিয়েছে! কাল রাতে আমাকে কল করে বলেছিলো বটে যে অফিস থেকে একজন আসবে,
আজ্ঞে হ্যাঁ বললো শ্রীকান্ত
কার্ডটা শ্রীকান্তকে ফেরত দিয়ে বললেন, হুম তা বলতো দেখি কি ব্যাপার | আগেই বলে দিচ্ছি নতুন লেখাটেখা কিন্তু হবে না | শ্রীকান্ত ব্যাস্ত হয়ে হেসে বললো নানা ওসব নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে আসিনি আমি | আমাদের এই মাসের রবিবার একটি ক্রোড়পত্র ছাপা হয়ে বেরোবে, এবারের ক্রোড়পত্রতে আপনার জীবন নিয়ে লেখা বের করতে চাই আমরা, তাই স্যার আমাকে পাঠালেন |
রমণী মোহন বাবুর মোটা ভুরুটা ওপর দিকে তুলে বললেন, আমার ব্যাপারে? আর কি নতুন বের করবে? আমার ব্যাপারেতো আগেই কত কি ছেপে বের করেছে, নতুনতো কিছু নেই আর, লেখাটেখাতো কবেই ছেড়ে দিয়েছি | তুমি বরঞ্চ ওই আগের কিছু লেখা দেখে তোমাদের মতো লিখে দাও | রমণীবাবু উঠবার প্রস্তুতি নিলেন |
ঠিক তখনই শ্রীকান্ত বলে উঠলো, “ওটার ওপরই আমি লিখতে চাইছি”,
রমণীবাবু বললেন, কি নিয়ে?
ওই যে আপনি কেন হঠাৎই লেখা ছেড়ে দিলেন? খ্যাতির উচ্চশিখরে থাকা মানুষটা হঠাৎ করে লেখা থেকে সরে এলেন কেন?
একটা বিরক্তিতে রমণী বাবুর মুখটা ভোরে গেল, এতে আর নতুন কি? আগেও বহুবার বলেছি সবারই সময় থাকতে সরে আসতে হয় | এই ধরনা গাওস্কর, অত ভালো খেলছিল, হঠাৎই ছেড়ে দিলো, এই একই কারণে, আর তাছাড়া সবই তো পেয়েছি জীবনে, আর ভালো লাগছিলো না |
শ্রীকান্ত বললো “তাই কি”? আজও আপনার লেখা হট কেকের মতো সেল হয়, বছরে অন্তত একটা লেখা তো অনায়াসে আপনি বের পারেন, কিন্তু কত বার বলা সত্ত্বেও লেখা দিতে আপনি নারাজ | আমাদের পাবলিকেশন হাউস থেকেও তো কত বার কিছু লেখা দেবার কথা বলা...
কথাটা শেষ করতে দিলেননা রমণী মোহন বাবু, থামো থামো, তুমি কি বোঝো যে ছোকরা? লেখা কি অতই সহজ? আমি অর্থের অভাবে লিখিনা, একটা লেখার জন্য আমি কোথায় কোথায় ঘুরেছি, কত রাত কাটিয়েছি এমন সব জায়গাতে তোমরা ভাবতে পারবে না, কত মানুষের সাথে তাদের মতো করে মিশেছে, তাদের মনের মতো হয়ে উঠে তবেনা তাদের কথা জেনেছি, তারপরে না সেসব সাহিত্য করেছি, আর এই বয়েসে ওসব ধকল সয়? আর আমি বাপু ওই বিদেশী লেখকের গল্পকে নিজের নাম দিয়ে চালানো মানুষ না | আমি চিরকাল গল্প লিখেছি, আমাদের দেশের মানুষের ওপর |
শ্রীকান্ত সসবস্ত হয়ে উঠে বললো, না না, ছিছি স্যার, আমাকে মাফ করবেন, আমি ওই কথা বলতে চাইনি, আসলে আমি নিজেও লেখক হতে চেয়েছিলাম, পারিনি, আর আপনার মতো একজন বড়মাপের লেখক লেখা ছেড়ে দিলেন তাই একটু আবেগঘন ভাবে বলে ফেলেছি স্যার, আমাকে মাফ করবেন |
রমণী বাবু এবার একটু যেন কোমল হলেন | বললেন লেখক হতে পারিনি মানে? বয়েস চলে গেছে নাকি? বেশ একটা স্নেহের ছলে বললেন, কি লেখো? গল্প না কবিতা?
শ্রীকান্ত সলজ্জ ভাবে বললো গল্প, মানে আপনার মতোই; ওই রহস্য গল্গ, কিন্তু ওই জানেনই তো, নাম না হলে ছাপবে না কেও, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, গাঁটের করি খরচ করে লেখা ছাপাবো, সেই হিম্মতও নেই |
রহস্য গল্প? ভালো ভালো
আচ্ছা তা বাবা আমি উঠি, তুমি আমার ব্যাপারে কি লিখলে সেটি একটিবার আমাকে দেখিয়ে যেও, আর তারপর নাহয় ছেপে বের কোরো | উঠে পড়লেন রমণী বাবু, যাবার আগে শ্রীকান্ত ওনাকে আবারও প্রনাম করে বেরিয়ে এল |
অফিসে ফিরে ওর বস সোমনাথ সরকারকে সবটা বলতেই হোহো করে হেসে উঠলেন | আমি জানতাম উনি এটাই বলবেন | শ্রীকান্ত অভিমানের সুরে বললো, তাহলে পাঠালেন কেন খামোকা?
এক্সপেরিয়েন্স এর জন্য, অত বড়ো মাপের মানুষটার দেখা পেলে যে !! ওনার সাথে তো দেখা করাই তো দুস্কর | তা শেষমেস কি কথা হলো?
শ্রীকান্ত উত্তর দিলো, না মানে উনি বলেছেন ওনার ব্যাপার এর আগে প্রকাশিত আর্টিকেল গুলো নিয়ে কিছু ইনফরমেশন জোগাড় করে লিখতে আর একবার ওনাকে দিয়ে ফাইনাল প্রুফ তা কন্ফার্ম করিয়ে নিতে |
তোফা, তবে ভালোই হলো, ইন্টারনেট ঘেটে আর কিছু অন্য পত্রপত্রিকা ঘেটে লিখে ফেলো, আর শোনো যাবার আগে আমাকে একবার দেখিয়ে নিও, কারণ, তেমন কিছু কন্ট্রোভার্সিয়াল কথা বার্তা লেখা যাবে না |
শ্রীকান্ত চেয়ার থেকে উঠে যাচ্ছিলো, শেষের কথাটা শুনে বললো, কন্ট্রোভার্সিয়াল মানে? ওনার জীবনে কি প্রেম-টেম কিছু আছে নাকি? জানতাম তো বিয়ে থা করেননি, তাহলে ওনার কি অন্য দোষ আছে নাকি?
ব্যাস, পেয়ে গেলে রসালো ব্যাপার! মন্তব্য করতেও ছাড়লে না | কত্ত গুলো কথা বলে ফেললে ভেবে দেখো একবার | এই না হলে বাঙালি | বললেন সোমনাথ সরকার
শ্রীকান্ত লজ্জা পেয়ে বললো না না আপনি যে বললেন কি সব কন্ট্রোভার্সিয়াল ব্যাপার তাই মানে ভাবছি, কি আবার ব্যাপারটা ওই সব নাকি |
বিখ্যাত মানুষ আর কন্ট্রোভার্সি মানেই ওই সব? তবে এটা ঠিক শতকরা ৮০ টা লোকের তা হলেও ওনারা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা | উনি মানুষটা শুরু থেকেই অন্য রকম বুঝলে, ওনার এক জেঠামশাই ছিলেন, উনি ইংরেজদেরকে খুশি করে বিস্তর টাকা পয়সা কামিয়েছিলেন, পরে বাকি ভাইরাও বিশেষ করে রমণী বাবুর বাবা কলকাতাতে ব্যবসা পত্তর করে বিস্তর টাকা কামায় | পরে অবশ্য খুব বেশি রেখে যেতে পারেননি সে এক অন্য কারণে, কিন্তু আমাদের আলোচনা সেটা নিয়ে না |
ওনার মানে রমণী বাবুর কিছু পাগলাটে ব্যাপার ছিল ছোট বেলাতে, অনেক বার সাধু হবার জন্য ঘর ছেড়েছেন, বড়োলোকের ছেলে, তাই বাড়ির লোক মানবে কেন? সেই আবার টেনেটুনে ঘরে ফিরিয়েছিলো, কিন্তু বিয়ে-থা করে সংসারী করানো যায়নি কখনো | উনি বলতেন লেখক বা কোনো ক্রিয়েটিভ মানুষেরই নাকি বৌ থাকা উচিত না, আর থাকলেও সেই বিবাহিত জীবন নাকি তেমন সুখের হয়না, তা সে যাই হোক, ওনার ভবঘুরে স্বভাব চরিত্তটি ওনার লেখাতে ফুটে উঠেছে | এমন সরল আর সাবলীল ভাবে উনি গল্প কাহিনী লিখতেন যে মনে হতো সামনেই তা ঘটছে | আর শুনলে অবাক হবে, শুধু ছোটবেলাতে না, পরবর্তী কালে, কলকাতা শহরের নানা অলিগলিতে উনি ঘুরে বেড়াতেন, আর এই শহরের প্রেখ্হিতে অনেক ক্রাইম-এর নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে লিখতেন উনি | পরে ধীরে ধীরে অবশ্য অন্য কথাও শোনা যায়, যে গল্প গুলি নাকি ওনার না অন্যের থেকে শুনে বা টুকে লিখেছেন, কেও বলে ওই সব নানা মানুষের থেকে জেনেছেন, সেটাই নিজের ক্রিয়েটিভিটি বলে চালাচ্ছেন, কিন্তু মজার বিষয় হলো, উনি কোনো দিন ও এসব নিয়ে মুখ খোলেননি শুধু একবারই উনি টিভির একটি ইন্টারভিউ এ বলেছিলেন এসব লেখা নাকি উনি অল টাইম লেখেন না, কিছু বিশেষ মুহূর্তে এসব ওনার মনে ভেসে ওঠে, আর লিখে ফেলেন | পরে অবশ্য সবাই ওটাকে পাবলিসিটি স্টান্ট বলে দিলো |
আচ্ছা যাই হোক, এসব নিয়ে কিছু লিখবে না, একটা বেশ সাকসেস স্টোরি টাইপ লেখা লেখো | একজন বাঙালি ব্যাক্তিত্ব ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে লিখছেন, ওনার তো একাধিক বই বিদেশী সিনেমাতে বিক্রি হয়েছে, জানতো সেটা ? শ্রীকান্ত হ্যান সূচক মাথা নাড়লো | ওসব নিয়েই লেখো |
বেশ তাই হবে, বলে উঠে পড়লো শ্রীকান্ত | তারপরে সোমনাথদার কথা মতো ইন্টারনেট ঘেটে, ওনার ব্যাপারে নানা তথ্য পেলো সে, কি কি পুরস্কার পেয়েছেন আর খান পনেরো বিদেশী সিনেমাতে ওনার গল্প নেওয়া হয়েছে এটাও জানা গেলো | শ্রীকান্ত মনে মনে ভাবছিলো, এত সাকসেসফুল মানুষটা বিদেশে না গিয়ে যে আজও আমাদের এখানে বিশেষ করে কলকাতাতে আছেন, এটাই আমাদের ভাগ্যের | আজকাল তো সবাই রাজ্য ছেড়ে, মুম্বাই বা সাউথ-এ পাড়ি জমাচ্ছে |
পর দিন সকাল সকাল সোমনাথদার টেবিলে লেখা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেল শ্রীকান্ত | আজ তাকে আরো ৩-৪ জন মস্ত কবির সাথে দেখা করতে হবে, ওনাদের ও কিছু লেখা নেবে সে, আর ওনাদের ব্যাপার এ কিছু লেখা বেরোবে ওদের মাসিক পত্রিকাতে, সেই ব্যাপারে ইন্টারভিউটা নেবে সেই | অফিসে ফিরে সোমনাথদার কেবিনে ঢুকলো শ্রীকান্ত, সারাদিনের রিপোর্ট দিয়ে উঠতে যাচ্ছে, সোমনাথদা বললেন, রমণী বাবু লেখাটা খাসা লিখেছো, ওনার ছেলেবেলার ব্যাপারটা সুন্দর করে লিখেছো, ওনার ওই খেপাটে ভাব, ওনার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ভাব প্রকাশ, আর সেখান থেকে সাহিত্য এবং জীবন দর্শন মিলিয়ে মিশিয়ে একদম মাখো মাখো ব্যাপার করেছো তুমি, তোমার লেখার হাত বেশ ভালো শ্রীকান্ত, তোমার হবে যেন, একটু লেগে থাকো, তোমার ভবিষ্যত উজ্জ্বল আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি নিজেও দেখছি কিছু লেখা তোমার যদি বের করা যায় | কাল সক্কাল সক্কাল ওনার সাথে দেখা করে নিও, আমি আজ রাতে টেলিফোনে বলে রাখবো ওনাকে |
পরদিন সকাল এ শ্রীকান্ত পৌঁছে গেলো রমণী বাবুর বাড়ি, আজ উনি নিচেই ছিলেন, বাগানে পায়চারি করছিলেন, ওকে দেখেই বললেন, এস ইয়ংম্যান, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি | ঘরে গিয়ে বসলো ওরা |
কই দেখি কেমন লিখেছো বলেই রমণী বাবু হাত বাড়ালেন, শ্রীকান্ত সুন্দর ফাইলটা এগিয়ে দিলো ওনার দিকে | বেশ কিছুটা খাপছাড়া ভাবে পড়তে লাগলেন রমণী বাবু, ততক্ষনে চা, বিসকুট, ডিম্ টোস্ট সব এসে গেছে,
একবার সেই দিকে হাত দেখিয়ে রমণীবাবু বললেন, নাও, খেয়ে নাও সামান্য কিছু, শ্রীকান্ত একটু ইতস্তত করছিলো , মুখে বললো এসবের কিছু দরকার ছিল না স্যার, রমণী বাবু বললেন, সেই তো সকালে বেরিয়েছ, খাও খাও, তোমরা ইয়ং ম্যান , খাবে আর শরীর করবে, এখনো অনেক যুদ্ধ লড়তে হবে তো , মুখে বেশ একটা স্নেহের হাসি লেগেছে আজ তাঁর |
কিছু পরে রমণীবাবু চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন, বাহ্ বেশ লিখেছো তো | তবে এতটা বাড়াবাড়ি করে না লিখলেও হতো, আমার মধ্যে এত আধ্যাত্মিকতা কোনো কালেই ছিল না, আমি ঘর থেকে পালাতাম, মানুষ চিনবো বলে | মানুষ কে দেখবো বলে |
সেটা কিরকম শ্রীকান্ত বলে ওঠে,
সেটা? সেটা হলো এই ধরো, আমার তোমাকে ভালো লাগলো বা তোমার ক্যারেক্টারটা ইন্টারেষ্টিং লাগলো, তো তোমার ব্যাপারে আমার জানার ইচ্ছা হলো, আমি জুড়ে গেলুম তোমার সাথে | আমাদের ছোট বেলাটা অন্য রকম ছিল, তখনতো পড়াশোনার এত চাপ ছিল না, তাই কদিন কাটাতাম চাষীর ঘরে তো কটা দিন মুদির ঘরে | ওরা কেমন করে থাকে, কি খায় সব খুঁটিয়ে দেখতাম, আর ওরা সব আমাদেরই প্রজা তাই কেও তেমন আপত্তি করতোনা , ব্যাস লোকে এ কথা চালিয়ে দিলো ছেলেটা বেবাগী হয়ে চলে যেতে চায়, সংসারে মতি নেই | হাসছিলেন রমণী বাবু , চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাঁর, আর সেই সব মানুষকে এত কাছ থেকে দেখে, তাদের জীবন নিয়ে লিখতে শুরু করলাম
শ্রীকান্ত এবার বললো, কিন্তু আপনার লেখাতে তো সামাজিক এর থেকে বেশি সমাজের অন্ধকার দিকটা মানে ওই অন্যায়, খুন অত্যাচার এসব ধরা পড়েছে আর বিশেষ করে আপনার রহস্য উপন্যাস গুলো তো একদম অন্যরকম, আপনি কি সব রহস্য ওই সব মানুষদের থেকে জেনেছেন বা নিজের চোখে দেখেছেন? এত বাস্তবমুখী লেখা, যেন চোখের সামনে ঘটছে |
রমণীবাবুর মুখটা কেমন যেন বদলে গেল, শ্রীকান্ত চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো আপনি আসলে মানুষের সাথে মিশে তাদের মনের গভীরের কথা জেনে তাদের মতো করে লেখেন, সেদিন সোমনাথদার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল, উনি বলেছিলেন এই সব ব্যাপারে রমণীবাবু খুব সেন্টিমেন্টাল | কিন্তু রমণীবাবু চোটে গেলেন না, কেমন যেন চুপ থেকে বললেন, ওটা একদমই একটা আলাদা চ্যাপ্টার আমার লাইফ-এর |
ও রহস্য উপন্যাস লেখা পরে শুরু করেছিলেন? শ্রীকান্ত বললো
হ্যান, ওটা আমি লিখতে শুরু করি, যখন আমার বয়েস ওই ধরো ৩৪-৩৫ হবে |
আচ্ছা আচ্ছা, তার আগে সামাজিক লেখা লিখতেন? বাহ্, কিন্তু আমি আপনার ব্যাপারে লেখা পড়ে, সামাজিক গল্প বা উপন্যাস নিয়ে কিছুই জানতে পারিনি জানেন,
রমণী বাবুর মুখটা কেমন যেন উদাস মতো লাগলো শ্রীকান্তর , মুখে বললেন হুম
ফস করে শ্রীকান্ত বলে ফেললো, তা যদি কিছু সেরম পুরোনো অপ্রকাশিত লেখা থাকে, তো সেটা তো এখন গোল্ড মাইন, যদি আমাদের এই এডিশনর জন্য দিতেন |
এবার কিন্তু রমণী বাবু রূঢ় ভাবে বললেন, না না, আগেই তো বলেছি, লেখা দেব না, আর পুরোনো লেখা তো একদমই না |
প্রসঙ্গটা পাল্টে ফেলে উনি নিজেই তার পরে স্নেহ ভোরে বললেন, তোমার প্রতিভা আছে, তোমার হবে লেখাটি আমার বেশ ভালো লেগেছে | তুমি লেখাটা রেখে যাও, নিচে তোমার মোবাইল নম্বরটাও লিখে রেখে যাওতো , আমি কিছু কারেকশন করে রাখবো, হয়ে গেলে ফোন করবো |
শ্রীকান্ত নমস্কার জানিয়ে উঠে পরে
কেটে গেছে ৫-৬ দিন, বলা বাহুল্য আর মাঝে রা রমণীবাবু ফোন করেনি শ্রীকান্তকে |
কিন্তু আজ রাত ওই ১০ নাগাদ মোবাইলটা বাজলো শ্রীকান্তর
ওই দিকে রমণী বাবুর গলা , “শ্রীকান্ত একটিবার আস্তে পারবে?”
শ্রীকান্ত একটু যেন অবাকই হলো, “এখন? এত রাতে ? কাল সকালে যাই?”
কেমন একটা জড়ানো গলায় রমণীবাবু বললেন, কেন? রাতে কি রাস্তায় বেরোয় না মানুষ? না তোমার আবার ভুতের ভয়?
শ্রীকান্ত লজ্জা পেয়ে গেল |
না না, কিযে বলেন, একটু কথার মারপ্যাচ দিয়ে বললো, আমি আসলে ভাবছিলাম, আপনার বয়েস হয়েছে নিশ্চই টাইমে খাওয়া-দাওয়া করেন, এত রাতে আমি গেলে আপনার অসুবিধা হবে,
কিন্তু সে কথায় চিঁড়ে ভিজলো না, দৃঢ় ভাবে রমণীবাবু শুধু বললেন, তাহলে আধা ঘন্টার মধ্যে তুমি এসে যাও আমার বাড়ি, ডিনার সারবে আমার কাছে, পারলে বাড়িতে বলে এস কেমন; আজ রাতটা নাহয় আমার এখানে থাকলে, যদি না আপত্তি থাকে |
শ্রীকান্ত কেমন যেন অবাকই হলো, কিন্তু সে ভাবলো এটাই হয় তো সুবর্ণ সুযোগ, হয়তো নেশা-টেসা করে আছেন সামান্য, মনের অনেক গভীরে থাকা কথা নেশাতে মানুষ বলে ফেলে, সেটা যদি সে রেকর্ড করে রাখে, পরে রেফারেন্স হিসাবে কাজে দেবে, আর এই লেখার মাঝে মাঝে ঢুকিয়ে দেবে সে |
রাস্তা ফাঁকাই ছিল, তাই মাত্র ২০ মিনিটে সে পৌঁছে গেল রমণী বাবুর বাড়ি | চাকরটি, তাকে নিয়ে গেলো দোতলাতে, রমণী বাবুর স্টাডি রুম এ | বসে বসে কিছু একটা পড়ছিলেন মন দিয়ে রমণী বাবু, রুমটা দেখেই একটা আভিজাত্যের চাপ পাওয়া যায় | অসংখ্য বই-এ ঠাসা, স্বদেশী বিদেশী দুই ই দেখা যাচ্ছে | সামনের সোফাতে বসলো শ্রীকান্ত | রমণী বাবু কেমন যেন ধরা ধরা গলাতে বললেন, তোমার লেখাটাই দেখছিলাম, তবে কি জানো লেখার আমি আর বাস্তবিক আমি টা ভিন্ন কেও |
শ্রীকান্ত বলল , কিছু চেঞ্জ হবে কি আর?
রমণী বাবু একটু উদাস ভাবে বলতে লাগলেন, আমার তো ছেলে পুলে কেও নেই, বিয়ে থা ই করলাম না, বৌ বাচ্ছা আসবে কথা থেকে, তাই অনেক কথা আছে যা বলা হয় না যেন | এই যে আজকের রমণী মোহন দত্ত, সে কি করে শুরু করলো? সেটাই একটা কাহিনী জানো,
শ্রীকান্ত মনে মনে ভাবছিলো, সে তো এটাই জানতে চাইছিলো,
আচ্ছা তুমি সেদিন বলছিলে না আমার পুরোনো লেখা পাবলিশ করবে, দেখতে চাও আমার অপ্রকাশিত পুরোনো লেখা গুলো? অনেক বছর হয়ে গাছে, সেসব কেও আর পড়ে না দেখে না | ইশারা করে রমণী বাবু বললেন, সামনেই ওই ড্রয়েরটা দেখো, ওতে আছে |
শ্রীকান্ত ড্রয়েরটা টেনে বের করলো | বেশ কিছু মানুস্ক্রিপ্ট আছে, সেখান থেকে একটা বের করলো সে | রমণী বাবু বললেন পড়ো | শ্রীকান্ত পড়তে শুরু করলো | কিন্তু কিছুটা পড়েই কেমন যেন বিরক্ত হলো, এ লেখা রমণী বাবুর হতেই পারে না | এ তো নিতান্ত জোলো লেখা | সেই স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনে এর থেকে ভালো লেখা বের হয়, না না উনি কোনো ভাবে মস্করা করছেন বা হয়তো এটা অন্য মানুস্ক্রিপ্ট, পরের লেখাটা পড়তে লাগলো শ্রীকান্ত , সেই একই মানের লেখা |
ঘরে আলো একটু কম, টেবিল ল্যাম্প এর আলোতে পড়ছিলো শ্রীকান্ত, এবার শ্রীকান্ত তাকালো রমণী বাবুর দিকে,
ওনার বাম পাশের টেবিল ল্যাম্পের আলোতে কেমন জানো আলোআঁধারী তে ভরা মুখটা দেখা যাচ্ছে ওনার, ঠোঁটের কোনের বাঁকা হাসিটা যেন দেখতে পেলো শ্রীকান্ত,
রমণী বাবু বললেন কিহে, অবাক হচ্ছ নাকি? ভাবছো প্রখ্যাত লেখক রমণী দত্ত এ লেখা কি করে লিখলো? আমার নামে অনেক বদনাম আছে জানতো? নিন্দুকরা বলে আমি নাকি লেখা চুরি করি, আমি নাকি অন্যের লেখা দেখে কপি করি , কারণটা আর কিছুই না, আমার লেখক জীবনের শুরুর দিকের বেশির ভাগ লেখাই এরম ছিল, আর তাই বেশির ভাগ লেখা প্রত্যাখিত হতো নানা প্রকাশক এর ঘর থেকে, আর তারপর একদিন, তারপর একদিন… সেটা এল... চারি দিক নিস্তব্ধ, শেষের কথা গুলো রমণী বাবু কেমন বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন,
এক টানা ঝিঁঝিঁর শব্দ শুধু শোনা যাচ্ছে , শ্রীকান্তবলে উঠলো, তারপর কি রমণী বাবু
আঁ!! তারপর? তারপর আমার কাছে এলো সেই জিনিসটা, আর সব পাল্টে গেলো | কেমন একটা দাঁত বের করে হাসছে মানুষটা, সম্পূর্ণ অসংলগ্ন লাগছে ওনাকে, এই কি সেই রাশ ভারী রমণী মোহন দত্ত, চিনতে পারছে না শ্রীকান্ত |
শ্রীকান্ত বললো কি জিনিস?
তুমি দেখবে সেটা? কেমন একটা হয়ে গেলো রমণী বাবুর মুখ, নাঃ নাঃ থাক, সে বড় ভয়ঙ্কর, দেখতে হবে না, আমি কেউকে সে জিনিস দেখায়নি, তবে...একটু থেমে আবার বললেন - তবে কি জানো, ওটাই আমাকে গ্রেট গ্রেট রমণী মোহন দত্ত করেছে | বলেই অট্টহাস্সো করে উঠলাম রমণী বাবু
শ্রীকান্ত মনে মনে ভাবছে, এ বুড়োটা তো নেশায় চুর | উফফ কি কুক্ষনে এলাম যে |
আর তখন ই তাকে চমকে দিয়ে রমণীবাবু বললেন কি ভাবছো ? আমি নেশার ঘোরে প্রলাপ বকছি ?
শ্রীকান্ত চমকে গেলো, তবে কি সে মুখ দিয়ে কিছু বলে ফেলেছে?
আবার হাসতে লাগলো রমণী বাবু |
আর বললেন , না না তুমি মুখ দিয়ে কিছু বলোনি ছোকরা |
শ্রীকান্ত চমকে উঠে পড়লো, এ কি করে সম্ভব? সে একটা কোথাও বলছে না, আর ইনি সব কি করে জেনে যাচ্ছেন?
কি করে জানছি? কি করে বুঝছি? কারণ আমি আতর মেখে আছি | আবারও হো হো করে হাসতে লাগলো, রমণী বাবু |
নাঃ এত বেহেড মাতাল, কিসব বলছে, "আতর মেখেছি" !! সেটার কি মানে?
কিন্তু রমণী বাবুর দিকে সে তাকাতেই দেখলো, একখানা আতরের সিসি হাতে ধরা আছে তার | সুদৃশ্য শিশিটির ওপরে খাজ কাটা ঢাকনা, আর তার ওপর আলো পড়ে চিক চিক করছে|
রমণী বাবু বলতে লাগলেন, এ জিনিস পৃথিবীতে কারো কাছে নেই, এ শুধু আমার |
এ অনেক কাল আগের কথা | আমি বেশিরভাগ সময় এ থাকতাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে কোলকাতাতে মন বসে না, হীনমন্যতায় ভুগি, দিনের বেলা ঘরের বাইরে খুব কম বেরোতাম , শুধু বিকালে থেকে সন্ধে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই, তা তেমনই একদিন আমাদের গ্রামেরই বটতলা তে, দেখি একটা বুড়ি বসে আছে, তিন হাটু এক করে বসে আছে বুড়িটা | রাস্তার পাশেই বট গাছটা, একটু এগোতেই দেখলাম, আমাকে ইশারা করে ডাকছে, আরো একটু সামনে যেতেই বললো, কাছে আয়, আয় না, তোর জন্যই বসে আছি | আমি মনে মনে ভাবলাম, গ্রামের ই কোনো বুড়ি, গরিব মানুষ, হয়তো বা ভিক্ষা করে, হেসে বললাম, কি বুড়ি, খাবে কিছু? পকেট থেকে পয়সা বের করতে যাচ্ছি দেখি, সে তার ঝুলি থেকে এই শিশিটা বের করে সামনে ধরলো, বললো, নিয়ে যা, রাতে মেখে শুবি, বুঝিলি রে বাপ্ ? দেখিস, তর জীবন পাল্টে যাবে, সব পাবি, সব পাবি, বলে বুড়ি টা চোখ টা বুঝে বসে থাকলো, আমি শিশিটা হাত এ নিয়ে দেখলাম, সামান্য গন্ধ শুকলাম, দেখলাম, আতর, ভাবলাম বুড়ি হয় তো, আতর টা বিক্রি করতে চাইছে, পকেট এ যা ছিল তার বুড়ির সামনে রেখে বলাম, বুড়িমা, এটা নিও, আমি নিলাম তোমার আতর
বাড়ি এসে ভুলে গেছি আতরের কথা, পরেরদিন আবার সেই বটতলাতে গিয়ে দেখি, আমার রেখে যাওয়া টাকা তেমনই আছে, শুধু বুড়ি টা নেই | যাহঃ বাবা, টাকা না নিয়ে চলে গেল? আমি সেই টাকা স্পর্শ করলাম না, ভাবলাম, গ্রামের কোনো গরিব দেখতে পেলে কুড়িয়ে নেবে থাক পড়ে | কিন্তু সেদিন রাত্রিরে হঠাৎ পাঞ্জাবিটা কাচতে দেবার জন্য সরিয়ে রাখতে গিয়ে হাতে এ পড়লো সেই আতরের শিশিটা |
কি হলো কে জানে, গায়ের গেঞ্জি টাতে, লাগিয়ে দিলাম সামান্য আতর, বেশ হালকা মিষ্টি গন্ধ |
তার পরে রোজকার মতোই নিজের স্টাডি টেবিল এ গিয়ে বসলাম, লেখা পড়া করতে লাগলাম, কিছু একটা লিখি লিখি ভাবছি, একবার ভাবলাম, বুড়িটার কথা লিখি, কিভাবে জানি না ঘুমিয়ে গেছি, ঘুম ভাঙলো সেই সকালে, দেখি আমি টেবিলের ওপর লিখতে লিখতে কখন ঘুমিয়ে গেছি, উঠে, রোজকার কাজ কর্ম সেরে, আবার টেবিলে এসে বসতেই দেখি, বেশ কিছু লেখা সামনের পাতায়, কাল রাতে মনে হয় এটাই লিখছিলাম, কিন্তু কি নিয়ে লিখেছি কিছুতেই মনে পড়ছিলো না | পড়তে লাগলাম লেখাটা, কোনো এক রহস্য গল্প, যা আমি কখনো আগে লিখিনি , যা আমি কখনো লেখার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি , কিন্তু লিখে ফেলেছি, এ কেমন করে সম্ভব | আর লেখার মানতো আমার থেকে শত গুনে ভালো, বিশেষ করে শব্দ চয়ন ,এমন লেখা তো কস্মিন কালেও লিখিনি আমি , কিন্তু হাতের লেখাটা আমার, তাই কেও লিখে রেখে গেছে সেটাও হবার যো নেই |
শ্রীকান্ত অবাক হয়ে শুনছিলো, শুধু বললো তারপর?
এই হলো শুরু, রোজ রাতে আমি লিখতে বসার আগে, আতর মেখে নি, আর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি, আর সকালে এ উঠে দেখি আমি রাতে লিখেছি কোনো অনবদ্দ সৃষ্টি |
বেশ চলছিল, আর বলাই বাহুল্য, আমার লেখা ছাপা হতে লাগলো, নানা মাসিক পত্র পত্রিকাতে, নাম হচ্ছিলো ধীরে ধীরে, কিন্তু... আবার থামলাম রমণী বাবু
কিন্তু কি? শ্রীকান্ত জানতে চাইলো
কিন্তু আমার শান্তি ছিল না, কি করে এটা হচ্ছে জানার প্রবল ইচ্ছা জগতে লাগলো, একদিন রাতে , আতর গায়ে দিলাম, আর নিজের হাত দুটো কে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম, নিজে তো আর পারবো না, চাকরটাকে ডেকে বললাম “বাধ তো কষে”, সে প্রথম এ একটু অবাক হলেও বেঁধে দিলো, বিছানাতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম, কখন ঘুমিয়েছি জানি না, কিন্তু মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল, কিসের যেন একটা কষ্ট হতে লাগলো, যেন, প্রাণ টা বেরিয়ে যাবে, ছটফট করতে লাগলাম, কথা বেরোচ্ছে না, অনেক কষ্টে, ডাকা ডাকি করতেই, চাকরটা, এসে গেলো, আমাকে এরম ছটফট করতে দেখেই সে হাতের বাঁধন খুলে দিলো, আর আমিও এক ধাক্কা তে তাকে সরিয়ে দিয়ে গিয়ে বসলাম, চেয়ার এ, সামনের খাতার পাতাতে খস খস করে লিখে যেতে লাগলাম, তুমি বিশ্বাস করো শ্রীকান্ত, সে লেখা আমি লিখছিলাম না, কে যেন লিখে যাচ্ছিলো আমার হাত দিয়ে | আবার ও কখন ঘুমিয়ে গেছি, পরেরদিনও এই এক ঘটনা,
এরপরে আমাকে নেশাতে পেয়ে গেলো যেন, আতরের নেশা, রোজ রাতে আমি আতর মাখি, মাখতেই হবে, অনেক বার চেষ্টা করে দেখেছি, না মেখে কিছুতেই থাকতে পারিনি, মাখতে আমাকে হবেই, আর কিছু যেন ভর করতো আমাকে, আর সেটা জোর করে, কথা গুলো লিখিয়ে নিতো আমাকে দিয়ে |
চলছিল বেশ, তারপরে একদিন, কি ভেবে, আতরের শিশিটা খুলে দেখতে গেলাম, আর অনেকটা তরল আমার গায়ে পড়ে গেলো, সে কি গন্ধ তার, কেমন যেন করতে লাগলো হাত পা, আমি বিছানাতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম কিন্তু নড়বার চড়বার শক্তি হারিয়ে যেতে লাগলো,
সেইদিন আর ঘুম এলোনা আমার, জেগে থাকলাম, আর বার বার আমার শরীরের মধ্যে আস্তে লাগলো নানা জন | আর তাদের ভাবনা গুলো যেন আমার মধ্যে তারা ভাবতে লাগলো, কি অসহ্য যন্ত্রনা হতে লাগলো, মনে হতে লাগলো, মাথার শিরা ফেটে যাবে,
আর কি দেখলাম জানো?
কি? শ্রীকান্ত বললো,
আমি জেগে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমার সামনে ঘটে চললো, একের পরে এক খুন আত্মহত্যা, নারকীয় অত্যাচার , নানা কাহিনী, আর অভুত ব্যাপার, প্রতিটা কাহিনীতেই আমি আছি, কখনো আমার ওপর ঘটছে সেসব অত্যাচার, কখনো বা আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি, কিন্তু কিছু করতে পারছি না, আমার কোনো শক্তি নেই, আমার কি অসহ্য কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন, কিন্তু মরছি না, শুধু ভোগ করছি যন্ত্রনা, একটা করে গল্প শেষ হচ্ছে, পরে আবারো অন্য গল্পরা, শুরু হয়ে যাচ্ছে |
সকালে দেখলাম, অজস্র গল্প লিখেছি আমি, ছোট বড়ো নানা কাহিনী, আর আমার কাল রাতের প্রতিটা কথা মনে আছে আজ, সেগুলোই আমি খাতার পাতায় লিখেছি, কিন্তু এটা মনে পড়েনা, কখন সে লেখা আমি লিখলাম |
চমকে উঠলাম, এ কি জিনিস | না পারছি কাউকে বলতে, আর তখন আমার খাতির নেশা লেগেছে যেন, সে নেশা তো আতরের থেকেও বেশি, দিন নেই রাত নেই, আমি ওই আতর মেখে থাকতাম, আর আমার সামনে চলতো নারকীয় সব ঘটনা | সেইসব আমি কখন যেন লিপিবদ্ধ করতাম কাগজে, শুধু তাই না আরও বেশ কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো আমার জীবনে |
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, এই যেমন ধরো সামনেই বসে থাকা যে কোনো মানুষের মনের কথা বুঝে যেতে লাগলাম, কিন্তু সব থেকে অবাক করলো এটা দেখে শিশিটার তরল শেষ হচ্ছেনা, রোজই মাখি, কিন্তু পরদিন দেখি ঠিক ততোটাই আছে, এসব তো ঠিক ছিল, কিন্তু রোগ ধরলো, সে বিষম রোগ, আশেপাশে নানা কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনা কে বাস্তব না অবাস্তব, বুঝতে পারতাম না |
রমণী বাবুর কোনো কথাই আর শ্রীকান্তর কানে আসছে না , আতরের শিশিটার ওপর ক্রমশ লোভ বাড়ছে তার | একবার শুধু একটাবার যদি শিশিটা হাতে পেতো, তাহলে হয় তো নেক্সট বাংলা সাহিত্যের রহস্য উপন্যাস সম্রাট উপাধিটা তার মাথাতেই উঠতো | আজ কত কাল ধরে এমনই কিছু আশ্চর্য প্রদীপের কথা ভেবেছে সে | না না কিছুভাবে এটা তার চাই ই চাই | কিন্তু কিভাবে...
রমণীবাবু বলেই যাচ্ছেন তাঁর কথা , পাশের মানুষটাকে দেখেও মনে হতে লাগলো এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব, এই যেমন ধরণা, আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, তোমার পাশে বসে, আছে ওই রোগা ছেলেটা, যে হয়তো তোমাকে মারবে বলে আমার বাড়ি পর্যন্ত ফলো করেছে, হাতে ধরে আছে চকচকে ছুরি , হয়তো তোমার গলাতে ছুরিটা চালিয়ে দিয়ে, নিজের প্যান্টে সেটা মুছে নেবে,
শ্রীকান্ত চমকে ওঠে, দেখতে থাকে এদিক ওদিক, কেও তো কোথাও নেই, আর সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রমণীবাবু দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, সে কি ভয়ঙ্কর তাঁর মুখ, শ্রীকান্তর হাতটা ধরে, কিছুটা আতর ওই শিশি থেকে তার হাতে ঢেলে দিলেন তিনি | শ্রীকান্ত চমকে গেলো, এটা কি করছেন আপনি বললো শ্রীকান্ত, রমণীবাবু আবার ও গিয়ে বসে পড়েছেন তাঁর সোফাতে |
আমি ভাবছিলাম একটা গল্প লিখবো যেন শ্রীকান্ত, তুমি এতবার করে অনুরোধ করলে তাই ভাবছি, নাহয় দেবোই একটা গল্প তোমার পরবর্তী এডিশন এর জন্য | ভাসছে আমার সামনে চরিত্রগুলো...
একটু চুপ থেকে আবার ও বলতে লাগলেন, দুই ভাই ঝগড়া করছে, সম্পত্তির দখল নিয়ে, মারামারি হাতাহাতি, তারপর ...
আবার থেমে বললেন, ইস মেরে ফেললো নিজের বৌটাকে একভাই, শুধু অন্য ভাইয়ের নাম দোষ চাপাবে বলে, পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে...
কেমন হবে এটা বলতো?
শ্রীকান্তর কেমন একটা ঝিমুনি মতো এসেছিলো, কিন্তু সব কিছু শুনতে পাচ্ছে,
রামানিবাবু বলে চলেন বড়ভাইয়ের নামটা দেব পরান, আর ছোটোভাইটা , ছোটোভাইটা..
শ্রীকান্ত বলে সুভাষ...
আমার মামারবাড়ির গ্রামের ঘটনা, ওদের বাপ্ ঠাকুরদার ৩ বিঘা জমির লড়াই ছিল বহুদিন, সুভাষের বৌ এর হত্যা নিয়ে পুলিশ অনেক খোঁজ করেও কিছু কিনারা পায়নি, সুভাষ বাগের বৌকে পরান বাগ মেরেছে বলে ফাঁসি হয় শেষে |
না না নিজের হাতে বৌকে মেরে, পাতকুয়াতে ফেলে দেয় সুভাষ, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি. বললেন রামনিবাবু
কথা শেষ করতে না দিয়েই শ্রীকান্ত মিনতির সুরে বলে; আপনি আমাকে এই শিশিটা দিন, আপনি তো রিটায়ারমেন্ট নিয়ে ফেলেছেন লেখা থেকে, আমাকে শিশিটা দিলে, বাংলা সাহিত্যের নতুন দিকপাল হতে পারবো আমি, পা দুটো টলোমলো করছিলো শ্রীকান্তর, তাই রামানিবাবুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে |
বেশিদূর যেতে পারলোনা শ্রীকান্ত, শরীরের শক্তি নেই তার, কিছুতে যেন গ্রাস করছে তাকে, মনে হচ্ছে সে থেকেও নেই আর অন্যকেও জায়গা করে নিচ্ছে তার মধ্যে,
প্রথম সে দেখলো, কোনো গ্রামের বটতলাতে বসে আছে কোনো অজ্ঞাত বুড়ি, ফোকলা দাঁত বের করে হাসছে, আর বলছে, সব পাবি, তুই সব পাবি নে., শিশিটা নে… এবার শ্রীকান্ত দেখতে লাগলো নানা দৃশ্য, তার সামনে একজন নারী ও পুরুষ ঝগড়া করছে, মহিলাটি নানা ভাবে পুরুষটিকে অভিসম্পাত করছে, পরস্পর স্বামী স্ত্রী কথা বার্তাতে বোঝা যায়, আর হঠাৎই পুরুষটি সামনের ফুলদানির এক ঘা বসিয়ে দিলো মহিলার মাথায়, রক্তের ছিটে লাগলো শ্রীকান্তর মুখেও এটা কি দেখছে সে, ব্যাস, পাল্টে গেলো সিন, আবার শুরু হলো, অন্য নারকীয় ঘটনা, সেই পুরুষটি যেন শ্রীকান্ত নিজে, স্ত্রীকে খুন করে কলকাতার বড় রাস্তা দিয়ে ছুটছে শ্রীকান্ত ওরফে খুনি, পিছনে পুলিশ তাড়া করছে, তার হাতে উদ্দত রিভলভর, পুলিশের দিকে তাক করে চালালো গুলি, ওদিক থেকেও এল আঘাত, লাগলো তাঁর বাম পায়ে, লুটিয়ে পড়লো পিচের রাস্তায়, কি ভীষণ যন্ত্রনা, আর্তনাদ করে পড়ে গেলো শ্রীকান্ত, পুলিশ এসে ধরলো তাকে, নিদারুণ অত্যাচার করতে লাগলো তাঁর ওপর আর কখন যেন সেই অত্যাচারে প্রাণ হারালো...
চোখটা যখন খুলেছে শ্রীকান্ত, সে রমণীবাবুর বাবুর স্টাডি রুমের মেঝেতে শুয়ে আছে, ভোরের আলোতে ঘরের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে | ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে, সামনেই চেয়ার এ হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে রমণীবাবু, শ্রীকান্ত তার নাক ডাকার শব্দ পাচ্ছে | ওনার পাশের সুদৃশ্য টি-টেবিল এর ওপর রাখা সেই অভিশপ্ত আতরের শিশিটা | কালরাতে যে অমানসিক কষ্ট আর নারকীয় অভিজ্ঞতা সে পেয়েছে, তা কিছুতেই ভোলার না, মনে মনে ভাবে শ্রীকান্ত, চাইনা খ্যাতি, চাইনা হতে সাহিত্যের দিকপাল | সারা গায়ে বেথা, জ্বরজ্বর লাগছে তার, মাথাটা ভার হয়ে আছে | নিঃসাড়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে এল শ্রীকান্ত | আসার আগে মেঝেতে পড়ে থাকা, ফাইলটা তুলে নিলো সে, বারান্দায় সূর্যের মিষ্টি আলোটা তার কি ভালো লাগছে আজ, গত রাতের বিভীষিকা যেন প্রাতঃকালীন সূর্যের আলোকে মুছে যাচ্ছে | সামনেই একজন চাকরকে দেখে বললো, বাবুকে বোলো আমি বাড়ি চলে গেছি.
রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে বার বার তার গত রাতের সব কথা মনে পড়ছিলো, কি ছিল সেই শিশিতে? মাথাটা ধরে আছে তার, আজ অফিস যাবে না সে, শরীর খুব দুর্বল লাগছে | বাড়ি ফিরে শ্রীকান্ত স্নান সেরে সোমনাথদাকে জানালো, কাল রাতে, রমণীবাবুর বাড়ি ছিল আর অনেক নতুন ইন্টারেষ্টিং তথ্য জেনেছে, সব কিছু লিখে আগামীকাল অফিস-এ তার কাছে লেখাটা জমা দেবে | বলা বাহুল্য, শিশিটার কথা কিছুই উল্লেখ করলো না সোমনাথদাকে |
তখনো চমক বাকি ছিল শ্রীকান্তের কাছে , দুপুরে লেখাটা নিয়ে বসলো সে, রমণীবাবুর ইন্টারভিউয়ের যে খসড়াটা জমা করেছিল তার প্রথম পাতাটা উল্টে দেখলো, প্রিন্ট কপির উল্টো সাদা দিকে তারই হাতের লেখায় লেখা আছে একটা রহস্য গল্প, টাইটেল হলো "একটি প্রেমের হত্যা" লেখাটা পড়তে লাগলো শ্রীকান্ত ...
দেবার্ঘ্য মুখার্জী
ভারত।
ইমেইল: friend.welcome.2008@gmail.com