দেবার্ঘ্য মুখার্জী
সম্মোহন
দেবার্ঘ্য মুখার্জী |
এইতো যেমন ধরুন সোনালী, মাত্র এক বছর হলো এসেছে কোম্পানিতে, মাইনে পায় মাত্র ৮৩০০ টাকা কিন্তু হাতে IPHONE ১১ ম্যাক্স, ওলা উবের ছাড়া অফিস আসে না, তারপর পিঙ্কি emi তে গাড়ি কিনেছে গত দুইমাস হলো, ওরও তো মাইনে মাত্র ৭৩০০ টাকা, তা এসব আসে কোথা থেকে, এর জন্য স্মার্ট হতে হয়, কাস্টমার এর চাহিদা বুঝতে হয়, এসব কি আর শুধুই কোম্পানির পলিসি বোঝাতে পারলেই হয় নাকি? অন্য রকম পলিসি আছে এর জন্য | আসলে সার্ভিস আর প্রোডাক্টের পাশাপাশি মানুষ নিজেকেও বিকিয়ে দিচ্ছে | ১২সি বাস এ চড়ে অফিস যাওয়া গুরুপদ এখনো নোকিয়ার বোতাম টেপা ফোন এর মতো ওল্ডই থেকে গেছে | নেহাত অনেকদিন ধরে আছেন কোম্পানিতে, তাই টিকে আছেন | কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে, তাও বেশি দিন আর থাকবে না | বিশেষ করে নিউ জোনাল হেড হয়ে এসে বসেছে, রোহিত আগারওয়াল, পূর্বতন বস এর ভাইপো |
জানকিলাল আগারওয়াল মানে পূর্বতন বস এর সাথে গুরুপদবাবু বেশ একটা ভালো সম্পর্ক করে ফেলছিলেন, তাই অসুবিধা হতো না, কিন্তু বর্তমান বস ছেলেটি, কিছুতেই যেন গুরুপদকে সহ্য করতে পারে না, সেটা ওনার বেশি বয়েসের জন্য নাকি, ওনার জেন্ডার এর জন্য, সেটা বোঝা মুশকিল, ছেলেটি বস হয়ে আসবার পর থেকেই, অফিস থেকে ধীরে ধীরে পুরুষ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে, আর সুন্দরী কম বয়েসী মেয়েদের চাকরি বেশি বেশি করে হচ্ছে কোম্পানিতে |
ওনাদের কোম্পানি নানা রকম ফিনানফিকাল ইন্সট্রুমেন্টের ডিলার, যেমন IPO , মার্কেট লিংকড ইনভেস্টমেন্ট, তাই মূলত বড়োলোকেরাই ওনাদের ক্লায়েন্ট | সাধারণ মদ্ধবিত্ত বাঙালি এসব রিস্কি জায়গাতে ইনভেস্ট করতে ভয় পায় | তাই বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট হলেন অবাঙালি | একটা সময় কিন্তু এই চাকরিতে খুব সাফল্যের সাথে কাজ করেছেন গুরুপদবাবু | প্রতিমাসে কোম্পানি যে প্রথম ৩ জন বেস্ট সেলসম্যান অ্যাওয়ার্ড দেয় তার লিস্ট এ একটা নাম হামেশাই তার থাকতো | আর তাই পুরুস্কার হিসাবে পাওয়া, বছর শেষে ঘুরতে যাবার অফার থেকে শুরু করে টিভি ফ্রিজ অনেক কিছুই তার বেলেডাঙ্গার ছোট্ট সংসারটা সাজাতে কাজে লেগেছে | বিয়ের পরে স্ত্রীর ভাগ্যে স্বামীর উন্নতি, কথাটা একজন জোতিষী ওনার হাত দেখে বলেছিলো | হা একদম তাই, সুলেখা মানে গুরুপদবাবুর স্ত্রী খুব লক্ষি মেয়ে | ধীরে ধীরে ওনার ব্যাচেলার ঘরটাকে সাজিয়ে ঘুছিয়ে সংসার করে তুলেছে সে | পর পর দুটো মেয়ে হয়েছে, ঠাকুরের কৃপায় ওদের এবার একটা ভালো জায়গা করে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত |
বড় সাহেব ডাকছেন আপনাকে, ভাবনায় ছেদ পড়ে, পাঁচু ওরফে পঞ্চানন, অফিসের পিওন ডাকলো গুরুপদবাবুকে | উঠে দাঁড়িয়ে ভুঁড়ির নিচে নেমে যায় প্যান্টটা একটু টেনে ওপরে তুলে পাঁচু কে বললেন, মুড কেমন রে?
রিমা ম্যাডাম সবে বেরিয়ে এল, ভালোই থাকবে এখন সাহেবের মুড, বলেই ফ্যাঁস করে হেসে দেয় পাঁচু |
আচ্ছা আচ্ছা, বলেই কনফিডেন্স এর সাথে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েন রোহিত আগারওয়ালের ঘরে |
গুড আফটারনুন স্যার, ডাকছিলেন আমাকে?
আজ কত সেলস হলো আপনার? টেবিলের ওপর সুন্দর কাজ করা পেপারওয়েট তা ঘোরাতে ঘোরাতে প্রশ্ন করলো রোহিত আগারওয়াল |
ওই কাঁচের ঘরের এপাশ থেকে সোজাসুজি তাকালেই হোয়াট বোর্ড টা দেখা যায়, তারমানে জেনেশুনেই প্রশ্নটা করছেন উনি |
হয়ে যাবে স্যার, পুরোনো কিছু ফলোআপ ক্লায়েন্ট আছে আসা করছি ওগুলো আজ কনফার্মেশন দিয়ে দেবে, এখন তো বাজে ৩:০০ ওই ৪:৩০ নাগাদ ফোন করবো, এই ধরুন ১৫ লাক্স মতো উঠেই যাবে হেসে খেলে,
চুপ করুন, ১৫ লাক্স দেখাচ্ছে আমাকে | গত তিন দিনে ১ টা টাকার সেলস নেই আপনার, দেখুন আপনার যদি মনে হয়, সেলস আপনার জন্য না, তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি আপনাকে অন্য কিছু ডিপার্টমেন্ট এ দিয়ে দেব, নাহয় ডক বয় এর কাজ করবেন, ডক বয় হলো, যারা, কাস্টমার এর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডকুমেন্টস নিয়ে এসে অফিস এ জমা করে | এই বয়েসে সেটা ওনার দ্বারা সম্ভব না, তাই একবার ওই ডিপার্টমেন্ট এ ফেলে দিলে, নিজে থেকেই চাকরিটা ছেড়ে দেবেন গুরুপদবাবু এটা জেনে বুঝেই কথাটা বলছে রোহিত আগারওয়াল |
না না স্যার, সেলস আমার রক্তে আছে, কটা দিন একটু ব্যাড প্যাচ চলছে, সামনের মাসে ঠিক টার্গেট এর থেকে বেশি কিছু কাজ তুলে দেব দেখবেন স্যার |
ব্যাড প্যাচ বেশি দিন ছিল বলেই তো আপনাদের সৌরভকে টীম থেকে বের করে দিলো, তা, আপনিও তাহলে টীম এ থাকছেন কেন? ডিসগাস্টিং | এক্সকিউসেগুলো আমাকে দেবেন না, বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বললেন রোহিত |
সেন্ট্রাল AC এর হওয়া খেয়ে আর ক্লায়েন্টদের থেকে অপমান সহ্য করতে করতে চামড়াটা এতদিনে বেশ মোটা করে ফেলেছেন গুরুপদ, তাই মুখে হাসি রেখে বললেন, হেহে কিযে বলেন স্যার, আমি সামনের মাসে টপ সেলস এর লিস্ট এ এসে যাবো গেরেন্টি |
এসে গেলেই ভাল , নাহলে আমাকে আপনার জন্য অন্য কিছু ভাবতেই হবে | এখন সামনে থেকে যান, বলেই রোহিত একটু সরে এসে, নিজের ল্যাপটপ এ কিসব লিখতে লাগলো |
বাই স্যার, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন গুরুপদ
মেজাজটা দিন দিন হারাচ্ছে গুরুপদ, গত মাসে তার সেলস এর রিপোর্ট কার্ড ভালো ছিল না, কিন্তু এই মাসে খুবই খারাপ অবস্থা | জোতিষ সম্রাট শ্রী শ্রী ত্রিপাদ মহারাজকে কয়েক মাস আগেই উনি কুষ্টি বিচার করালেন, তিনি কিন্তু বলেছিলেন আগামী দিনে খুব ভালো সময় আস্তে চলেছে তার তবে লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিলে ওনার ক্ষতি হবার সম্ভবনা আছে, লোভ করা দূরে থাকে, কিন্তু তেমন আভাস তো কিছুই মিলছে না উল্টে চাকরিটা টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে উঠছে এখন |
আজ অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা এলেন কলেজ স্ট্রিট , বড় মেয়েটার কিছু বই লাগবে, অনেক দিন বলছে, কিনে আনাই হয় নি |
"দাদা RN সেন এর বাংলা সহায়িকাটা আছে?"
"৩৫০/- নতুন প্রিন্ট" দোকানদার জবাব দেন |
পকেট থেকে টাকা টা বের করতে গিয়ে কি একটা কাগজ রাস্তাতে পড়ে গেল গুরুপদর | নিচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিতে যাবেন, তখনই চোখে পড়লো ওইদিকের ফুটপাথ এ পুরোনো বই নিয়ে বসেছে একটা লোক, এর কার্ডবোর্ড এ লেখা আছে, সব বই ২০/- টাকা মাত্র |
এসব পুরোনো বইয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ভালো বইও পাওয়া যায় | মেয়ের বইয়ের টাকাটা মিটিয়ে, ফুটপাথ এর এই দিকে চলে এলেন তিনি | অনেক বই নিয়ে বসেছে লোকটা আর তিনি ছাড়া খদ্দের বেশি নেই, তাই হাটু গেড়ে বসে, বইগুলো দেখতে লাগলেন গুরুপদ,সব বইগুলোই অল্পসল্প ছেঁড়া, নাহলে কোনো কালে জলে ভিজেছিলো, কোনো টা পোকায় কাটা | মনে মনে ভাবলেন, তা রেজেকশন পিস্ বলেই না এত সস্তাতে ছাড়ছে |
অনেক কিছু ঘেটে দেখার পরে , এই বইটা চোখে পড়েছিল তার |
গত ৩ রাত ধরে গভীর ভাবে যেটা সে চর্চা করছে, বৌ সুলেখা ঘুমিয়ে যায় ১১টার মধ্যেই, তাই টেবিল ল্যাম্পের আলোতে, মন দিয়ে বইটা পড়ছেন তিনি, মদনমোহন তর্কালংকারের লেখা "গুপ্ত মহাবিদ্যা" | সম্মোহন, মারণ, উচাটন, বানমারা, পিশাচ তন্ত্র অনেক কিছুই ছিল বইটাতে, কিন্তু বইটার সব কটা পাতা নেই, অধিকাংশ্যই ছিঁড়ে গেছে বা পোকায় কেটেছে | কিন্তু সম্মোহন এর পদ্ধতি পুরোটাই লেখা আছে | সেটাই মন দিয়ে পড়ে চলেছে গুরুপদ |
মদনমোহন তর্কালংকার বীরভূম জিলার কুন্তলি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন, ওকালতিই তার পেশা হলেও ধীরে ধীরে তন্ত্র মন্ত্র ডাকিনি যোগিনী নানা বিদ্যাতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন | ওই গ্রামেরই পশ্চিম কোনে একটি ছোট মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন উনি সম্পূর্ণ নিজের অর্থে আর তাতেই করতেন ওনার সাধনা |
বইটি ঠিক সেইভাবে শুধুই তন্ত্রমন্ত্রের বই না, ভদ্রলোক তার জীবনের নানা কথা লিখেছেন আর তারই মাঝে মাঝে গোপন তন্ত্র বিদ্যার কথা লিখে গেছেন, ছোটোখাটো পদ্ধতি যেমন শুভ রং, শুভ বার বিচার করা কিংবা দূর থেকে একজন মানুষকে দেখে কি করে চিনবেন তার চরিত্র প্রভৃতি | নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে, এসব বিদ্যা শিখেছেন তিনি | বেশ কয়েক মাস কাটিয়েছেন হিমালয়াতে, কিছু দিন ছিলেন নেপালে | আর এই ঘোরাঘুরির মাঝেই, নানা সাধু সঙ্গ করেছেন, কারো কারো থেকে পেয়েছেন এমন সব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা যা কথায় প্রকাশ করা যায় না | পরে তিনি বুঝতে পারেন যে, টাকা পয়সা ভোগ লালসা সবই তুচ্ছ, মানুষের জন্ম হয়েছে অসীম জ্ঞান কে উপলব্ধি করতে | তাই পেশাদারি ওকালতি ছেড়ে তিনি গড়ে তোলেন আশ্রম | মানুষের জীবনের না না ছোট খাটো বাধা বিপত্তি নিজেই কি করে সে কাটিয়ে উঠতে পারবে, তাই মানুষকে শেখাতে উদ্যোগী হন |
বইটিতে যে কোনো মানুষ কে সম্মোহিত করার যে বিদ্যার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি জিনিস যেমন বেল কাঁটা, লাল বস্ত্র, ভুজ্জি পত্র, পুরানো পাকা ঘি এই যুগেও পাওয়া খুব মুশকিল না হলেও এমন কিছু জিনিসের উল্লেখ করা আছে যা একে বারেই ওনার নাগালের বাইরে যেমন মরা কাকের বাম পায়ের হাড়, শত বছরের পুরানো অশ্বত্থ গাছের মূল আর তারই গোড়ার মাটি, অমাবস্যা তিথিতে মৃত যে ব্যাক্তি ৩ পোর বেশি দোষ পেয়েছে তার চুল্লির পোড়া কাঠ প্রভৃতি | আর সাথে আছে বেশ কিছু গুপ্ত মন্ত্র | এই বিদ্যাটি মদনমোহনবাবু পশ্চিমবঙ্গেরই এক অখ্যাত গ্রামের কোনো বুড়ির থেকে শিখেছিলেন | গত কয়েকদিন ধরে বার বার করে ওই অংশটুকু পড়ছেন উনি, কোনো ভাবেই এই উপাদান ছাড়া আর গুপ্ত মন্ত্র না জেনে সম্মোহন বিধি নীতি সম্পূর্ণ করা যাবে না | গুরুপদবাবুর মনে বার বার আসছিলো একবার সম্মোহন শিখে গেলেই আর কিছু আটকাতে পারবে না তাকে, বলে বলে কাস্টমারকে নিজের মনের মতো প্ল্যান বিক্রি করতে পারবেন তিনি |
কেটে গেলো বেশ কয়েক মাস, কাজের চাপ যত বাড়ছে ওনারও জেদ চেপে যাচ্ছে এই পদ্ধতি শেখার, গত কয়েকমাসে, ইয়ার -এন্ডিং এর জন্য কোম্পানির কোনো এমপ্লয়ী সেভাবে সেলস করতে পারেনি, গুরুপদবাবুর অবস্থা আরও খারাপ | অবশেষে তাই চাকরিটা চলেই গেলো |
গত পরশুদিন রোহিত আগারওয়াল ডেকে ওনাকে বলেছেন, নো ওয়ার্ক নো পে , মানে সেলস হলে কমিশন হিসাবে টাকা দেবে কোম্পানি ওনাকে, ফিক্স ইনকামটা বন্ধ হয়ে গেলো ওনার | এখন থেকে রোজ রোজ অফিস না এলেও চলবে, শুধু প্রতি সপ্তাহে একবার এসে রিপোর্ট জমা করলেই হবে |
বাড়িতে ফিরে স্ত্রী কে বলবো বলবো করেও কথাটা বলা হলোনা | পরিবারের এক মাত্র রোজগেরে ব্যাক্তি সে, তারও চাকরি নেই বা থাকলেও টলোমলো সেটা সবার সাথে আলোচনা করার বিষয় নয় | সারাটা রাত ধরে আজ আবারো বইটা পড়ছিলো গুরুপদ, কাল অফিস যাবার তাড়া নেই | একটু বেশি রাতের দিকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে | ভোর রাতের দিকে গুরুপদ স্বপ্ন দেখলো স্বয়ং মদনমোহন মহারাজ ওনার সামনে এসে উপস্থিত, আর তিনি যেন বলছেন কিসের চিন্তা তোর? চলে আয় মায়ের মন্দরে, সব কিছু জোগাড় হয়ে যাবে | ধরফর করে উঠে বসলেন গুরুপদ |
সুলেখা বললো, কিগো এত দেরি করে উঠলে, অফিস এ লেট হবে তো |
না না আজ অফিস যাবো না, আমাকে ক্লায়েন্ট ভিসিট করতে বীরভূম যেতে হবে | বললেন গুরুপদ
"কোথায়! বীরভূম? কই কালকেও তো বলোনি", অবাক হয় সুলেখা |
আমি নিজেও কি জানতাম যেতে হবে, বলেই নিজেকে সামলে নেয় গুরুপদ, আসলে আমি ভুলেই গেছিলাম যে কাল ৫ তারিখ, এই এখন মনে পড়ছে, যাকগে তুমি ভাত তো করেছো? আমি ওই সামান্য কিছু খেয়ে, লোকাল হোক, ফাস্ট প্যাসেঞ্জের হোক, হাওড়া থেকে যা ট্রেন পাই ধরে চলে যাবো চিন্তা করো না |
খেতে খেতে সুলেখা একটু অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল, এত বছরের চাকরি জীবনে এই প্রথমবার গুরুপদ ক্লায়েন্ট কে মিট করতে যাচ্ছে অত দূর, তাও আবার সে ভুলে গেছিলো?
হ্যাগো ঠিক করে বলোনা কোথায় যাচ্ছ, এমন তো তুমি কোখনো করো না, বললো সুলেখা
গুরুপদ একবার ভাবলো স্বপ্নের কথাটা বলেই দি, তারপর ভাবলো কি দরকার, মেয়ে মানুষ এসব মন্ত্র তন্ত্র শুনে ঘাবড়ে গেলেই, বাস, আর কিছুতেই যেতে দেবে না, শেষে মাথায় হাত রাখিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে আটকে দেবে সুলেখা, তাই মুখে বললেন, আরে না না , এটা একটা প্রাইভেট পার্টি পেয়েছি আমি, কোম্পানির ও লাভ আছে আমার ও ২ পাইস বেশি ইনকাম | বোঝোই তো, ঝুনু বড় হচ্ছে, খরচ পাতি বাড়ছে | কত দিক ভেবে চলতে হয় আমাকে | তুমি কিছুটা ভেবো না, কটা দিনের তো ব্যাপার |
ঝুনু মানে গুরুপদের বড় মেয়ে ছোট বোনটাকে কোলে নিয়ে পটপট করে দেখছিলো বাবা কে |
সাদা জামাটা পরেই একটা ব্যাগ এ কিছু সামান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, সাবান, পেস্ট টুথব্রাশ ভোরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দুগা দুগ্গা নাম করে |
রিসারভিশন করা ছিল না, তাই একটা জেনারেল কামরাতেই উঠে পড়লেন তিনি | যাত্রাটা মোটের ওপর খারাপ হলো না তার |
বীরভূমে নেমে এদিক সেদিক জেনে, গ্রামে পৌঁছতে বেশি সমস্যাও হলোনা তার, বইয়ের পিছনে ছোট ছোট অক্ষরে আশ্রম আর গ্রামের ঠিকানা লেখায় ছিল |
বেশ মনোরম জায়গা, লাল রঙের মন্দির, পাশেই মদনমোহন মহারাজের আশ্রম | একদিকে গোয়ালঘর, পাশেই পুকুর, আশ্রমের সামনেই ৩-৪ জন মহিলা ও পুরুষ কাজ করছেন | গুরুপদ কাছে এগিয়ে এসেই তাদের একজন কে বললনে, মদনমোহন মহারাজ আছেন? আমি কলকাতা থেকে আসছি ওনার সাথে দেখা করতে |
লোকটি সামনের দাওয়াতে একটি আসন পেতে দিয়ে বসতে দিয়ে বললেন, "গুরুদেব গ্রামের এক শিষ্যের বাড়ি গেছেন তার খুব অসুখ, আপনি বসুন উনি আসে পড়বেন |"
ধন্যবাদ জানিয়ে কাঁধের ব্যাগটি নামিয়ে রেখে, আসনের ওপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন গুরুপদ | ওনাদের গ্রামের বাড়িটিও অনেকটা এরম ছিল, সকাল বেলা ওনার মা সামনের উঠোনটা এভাবেই ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতো, তুলসী গাছটাতে জল দিতো , ছোট বেলার দিন গুলো ভাবলে বড়ো ভালো লাগে তার | তখন অবশ্য বার বার মনে হতো কবে যে বড়ো হবো, আর তাই তো, বারো ক্লাসের পড়া শেষ করেই কলকাতা তে চলে এল কলেজ এ পড়তে, সেখান থেকে চাকরি | ছবির মতো পর পর মনে পড়ছিলো সব কথা | প্রথম যখন চাকরিতে এল , মাইনে ছিল মাত্র ২৫০০ টাকা, তাও কত খুশি ছিল সে, ধীরে ধীরে বিয়ে থা করে সংসার হলো, মেয়েরা হলো, খুশির অভাব ছিল না তার, কিন্তু বয়েস বাড়ার সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মনে হয় নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি বলেন আজ এত সমস্যা, এক সাথেই চাকরিতে এসেছিলো সুশান্ত সরকার , আমিতাভ মল্লিকরা | আজ ওরা সবাই বেশ ভালো নিজেদের গুছিয়ে নিতে পেরেছে , কিন্তু কোথায় যেন কালের সাথে তাল মেলাতে পারেননি গুরুপদ | অমিতাভ শশুরের টাকা নিজের বিসনেস খুলে বসলো এখন তো রমরমিয়ে চলছে তার ব্যবসা আর সুশান্ত ছেলেটা মস্ত ধড়িবাজ, চিট ফান্ড এর এজেন্ট হয়ে, লক্ষ টাকার এদিক ওদিক করে একদিন হওয়া হয়ে গেলো | শেষবার শুনেছে গুরুপদ যে বিদেশে আছে নাকি সে | ওরাই দেখছি ভালো আছে, আমার মতো ভালোমানুষ রাই কিছু করতে পারেনা জীবনে |
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঢুলুনি এসে গেছে গুরুপদর, এমন সময় কানে এল গুরু গম্ভীর গলাতে, কে যেন বলছেন, ব্যোম কালী, চমকে উঠেই তাকিয়ে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে লাল বস্ত্র পরিহিত একজন দীর্ঘ দেহি সুপুরুষ | ইনি যে মদনমোহন মহারাজ সন্দেহ নেই, বইয়ের ছবিতে দেখা মানুষটার সাথে মিল আছে হুবহু | দাওয়া থেকে নেমে উঠোনে এসে শ্রদ্ধা ভোরে প্রণাম করলো গুরুপদ | আমি কলকাতা থেকে এসেছি আপনার সাথে দেখা করবো বলে, আপনার বই আমি পড়েছি গুরুদেব, কিন্তু গুরু ছাড়া এই শিক্ষা যে সম্পূর্ণ হয় না তা বুঝেছি
| আমাকে দয়া করে এই সম্মোহন বিদ্যা যদি সেখান | মদনমোহন সামান্য হেসে বললেন, এস ভিতরে এস |
দাওয়াতে উঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে গুরুদেবের পিছন পিছন ওনার বসার ঘরে ঢুকলো তারা | ঘরটি বড়ো , একটি আরাম কেদারা আছে, নিচে সতরঞ্জি আছে পাতা | নিজে আরাম কেদারা তে বসে গুরুপদকে শতরঞ্জির ওপর বসতে বললেন |
কি নাম ?
আজ্ঞে আমার নাম গুরুপদ |
বাহ্ বাহ্ গুরু পদ , সুন্দর নাম |
আচ্ছা কি শিখতে চাও তুমি?
আজ্ঞে আপনার ওই সম্মোহনী বিদ্যা আমি শিখতে চাই | কলকাতার একটি সেলস কোম্পানি তে কাজ করি বাবা, চাকরি চলে যাবার জোগাড়, বয়েস হচ্ছে, এখন যদি চাকরি যায় খাবো কি? দিন কাল পাল্টে যাচ্ছে, পুরোনো পদ্ধতিতে আর কাস্টমার জোগাড় করা যাচ্ছে না বাবা, তাই যদি কোনো গুপ্ত বিদ্যার সাহায্যে, নিজের চাকরিটুকু বাঁচিয়ে রাখতে পারি, এই চেষ্টা করছি | আপনার বই থেকে আমি অনেক কিছু জেনেছি পড়েছি,বস্তু গুন্ দ্রব্য গুন্ আকার বিকার নিরাকার এসব সম্পর্কে ধারণা হলেও, হাতে কলমে তো দেখিয়ে দেবার কেও নেই, তখন ভাবলাম আপনি থাকতে, আমি কেনো ভাবছি, দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দিন বিদ্যাটি |
পিঠটা আরাম কেদারার ওপর ঠেকিয়ে ডান হাতে চোয়াল এ ভর দিয়ে সব কথা শুনছিলেন গুরুদেব | ঈষৎ হেসে বললেন, জীবিকার প্রয়োজনে তন্ত্র বিদ্যাকে ব্যবহার করতে চাও, এই তো? টা সেনাহয় শিখলে, তবে কি যেন বাবা এসব বিদ্যা অতি নিম্নমানের ক্রিয়ার জন্য ব্যবহার হয়, তাই এর পরিনাম ও হয় ভয়ঙ্কর | যেমন ধরো, তুমি মারণ শিখলে, অর্থাৎ, কালের আগেই কোনো মানুষের তুমি প্রাণ কেড়ে নেবার বিদ্যা, এখন সেই বিদ্যা ব্যবহার করলে তার ফল তো তোমাকে ভুগতেই হবে, কিংবা এই যে তুমি বলছো সম্মোহন, তার মানে প্রকৃতির নিয়ম না মেনে তুমি তোমার শক্তি দিয়ে তাকে পরিবর্তন করতে চাইছো | এর ফল কখনোই ভালো হবে না | তাই আমি বলিকি, প্রকৃত জ্ঞান এর উপলব্ধিতে মন দাও |
গুরুপদ বললেন, গুরুদেব, আমি সংসারী মানুষ, দয়া করে সম্মোহন বিদ্যা আমাকে সেখান, আমি আর আমার সংসার টা বেঁচে যাবে তাহলে |
এভাবে বহু কাকুতি মিনোতি করার পর, মদনমোহন বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে এই বিদ্যা শেখাতে পারি, তবে সেটার প্রয়োগ মাত্র ৩ বার করতে পারবে, মনে রাখবে, আমি তোমাকে শেখাচ্ছি, তাই আমি তোমার গুরু, ৩ বার এই শক্তিকে প্রয়োগ করার পরেই তা আবারো আমার কাছে ফিরে আসবে , আর কোনো ভাবে মানুষের ক্ষতির উদ্দেশে, বা কোনো মানুষের অধিকার কেড়ে নেবার উদ্দেশে, এই শক্তি তুমি প্রয়োগ করলে চরম বিপদ নেমে আসবে | আর শেষে এটাও বলি, কোনো ভাবেই এই শক্তি তুমি তোমার গুরু বা তোমার গুরুভাইয়ের ওপর প্রয়োগ করতে পারবে না, করলেও তা কাজে আসবে না | নিজের বা পরিবারের উন্নতি হেতু আর কোনো মানুষের হিতকর কর্মে শুধু এই শক্তি কে ব্যবহার করো এটাই আমার উপদেশ |
এবার গুরুদেবের পা ছেড়ে গুরুপদ জবাব দিলো বাবা আমি শুধু চাই বড় বড় পার্টি গুলো আমার কাস্টমার হয়ে যাক, বাস, তাহলেই চাকরিটা টিকে যাবে আমার বাবা |
বেশ বেশ, কয়েক দিন আমার আশ্রমে থেকে এই শিক্ষা লাভ করতে হবে, আর একবার মন্ত্র ও বস্তুর ব্যবহার এ সড়গড় হয়ে গেলেই, গৃহে ফিরে গিয়ে ব্যবহার করো |
“শিবাশিস, একবার এদিকে এস তো ”, বলে কাকে যেন ডাক দিলেন| কিছু পরেই সেই সকালের ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলো, আর ওনাকে গুরুদেব বললেন "এ আজ থেকে এখানেই থাকবে কিছু দিন, আমার কাছে শিক্ষা লাভ করবে, তুমি আশ্রমের কোনো একটা ঘর পরিষ্কার করে, ওকে থাকার ব্যবস্থা করে দাও |"
"আজ্ঞে গুরুদেব, আসুন আমার সাথে ", বলে শিবাশিস গুরুপদ বাবুকে ডাকলেন |
আশ্রমে ২০-২৫ জন আবাসিক থাকেন, সকলের কিছুনা কিছু কাজ ভাগ করা আছে, যেমন ৩-৪ জন শুধু গরুর সেবা করে, কেও আবার মন্দিরের সেবাইত, কেও দেখেন রান্না বান্না , কেও ঘরদোর পরিষ্কার, মন্দিরের এক পাশে অনেকটা জমিতে চাষ আবাদ হচ্ছে, সেখানে কাজ করছে কয়েক জন | ব্যাগ রেখে, স্নান করে এসে ঘরে ঢুকতেই গুরু[অডিও দেখলো নতুন কাচা ধুতি আর ফতুয়া নিয়ে অপেক্ষা করছে শিবাশিস |
সমস্ত আশ্রমটি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো গুরুপদ, মনে মনে বেশ একটা ভক্তি ভাব জাগছে তার | সন্ধেবেলা আরতি হলো, গ্রামের অনেক মানুষ এসেছিলো দেখতে | রাত্রিবেলা গুরুদেব আর বাকি সকলে একসাথে খেতে বসেছিল | নানা কথা বলতে লাগলেন গুরুদেব, বিহার প্রদেশের একজন তান্ত্রিক সাধুর পাল্লায় পরে সে কি হেনস্থা হয়েছিল ওনার তাও বললেন | সেই সাধু নাকি নিম্ন শ্রেণীর তান্ত্রিক, নিজের শক্তির প্রদর্শন করতে, বহু নিরীহ মানুষ কে ক্ষতি করেছে |
গুরুপদ বাবু মনে মনে ভাবছিলেন, কলকাতার মানুষের কোনো ধারণেই নেই, ওই ধুলো ওড়া শহরের ব্যাস্ত জীবনের বাইরে এমন একটা নিস্তরঙ্গ শান্ত জীবন থাকতে পারে | তারপর ই মনে পড়ছিলো, তার নিজের স্ত্রী আর মেয়ে দুটোর কথা |
হয়তো ছোট মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে আর বড় মেয়ে ঝুনু, "বাবা কখন আসবে, বাবা কখন আসবে " এই বলে সুলেখাকে বিরক্ত করছে |
বাঁধাকপির তরকারি, রুটি, আলুভাজা, খাঁটি গরুর দুধ এই হলো রাতের মেনু |
খাওয়া দাও সেরে, সকলে এসে গুরুদেব কে একবার করে প্রণাম সেরে যে যার ঘরে চলে যেতে লাগলো |
গুরুপদ প্রণাম করতেই, গুরুদেব বললেন, কাল ঠিক সকাল ৫:০৪ এ সূয্যদ্বয়, তুমি আমার ঘরে চলে আসবে, তোমাকে আমি শিক্ষাদান শুরু করবো |
এরপর কেটে গাছে ১২ দিন, সকাল সন্ধ্যা নিত্য নৈমিত্তিক, শিক্ষা লাভ করেছে গুরুপদ | মাঝে একদিন সারারাত গুরুর সাথে শ্মশানে কাটিয়েছে, জোগাড় করেছে, মৃতের পোড়া কাঠ, শিবাশিস এর সাথে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এনেছে মরা কাক |
এই সবের মধ্যে একদিন শুধু বাড়িতে ফোন করে স্ত্রী কে জানিয়েছে, কয়েক দিন পরেই সে ফিরছে, কোনো চিন্তা না করতে, সুলেখা বার বার জানতে চেয়েছে, কি কাজে গেছো তুমি, এমন তো কখনো হয় না তোমার, কোথায় আছো? কি খাচ্ছ? তোমার অফিসের থেকে সেদিন একটি ছেলে এসেছিলো, বললো, তুমি নাকি অফিস যাওনা বলে ওনারা খোঁজ করছে, তোমাকে ফোন এ পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বাড়ি ফেরার পথে দেখা করতে এসেছিলো সে |
গুরুপদ এই কথা সেই কথা বলে স্ত্রী কে বোঝালেন, একটা বিশেষ কাজে তিনি এসেছেন, অনেক বড় পার্টি, এখানে থেকে কাজ টা করে বাড়ি ফিরবেন, অফিস এ সব কথা তিনি জানাননি , কারণ, অন্যরা জেনে গেলে, তার এই কাজ টা তারাও ধরতে আসবে, কিন্তু কিছুতেই আসল সত্যি টা স্ত্রী কেও জানালোনা সে |
সেদিন রাতে গুরুদেবের সাথে দেখা করে নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছিলো গুরুপদ, গুরুদেব বললেন, কালই তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে, তুমি রাত ৩:১৫ তে ব্রম্ভ মুহূর্তে উঠে স্নান করে খালি পায়ে আশ্রম থেকে সোজা চলে যাবে ওই শিব মন্দিরের কাছে, দেখতে একটা অসত্য গাছ আছে, হাতে করে মাটি খুঁড়ে তার শিকড় আর গোড়ার মাটি আনবে, কিন্তু মনে রেখো, হাতে করেই মাটি খুঁড়বে আর কোনো পাত্রে মাটি আনা যাবে না,
আজ্ঞে বলে গুরুপদ ফিরে গেলো ঘরে | উত্তেজনায় ঘুম এল না তার |
সারা রাত জেগে থাকলো, ঠিক সময়ের অনেক আগেই উঠে স্নান করে বসে ছিলো, সঠিক সময় আসতেই, বেরিয়ে পড়লো , রাস্তা ফাঁকা, শুধু কয়েকটা কুকুর ডাকছে | শিবমন্দিরের সামনে এসে দেখলো , গুরুদেব তার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত, পাশে দাঁড়িয়ে শিবাশিস, তার হাতে একটা পাত্র, সেখান থেকে জল নিয়ে, মন্ত্র পড়ে, গুরুপদকে শুদ্ধ করলেন মদনমোহন,
সামনের অশ্বত্থ গাছের গোড়াতে ঢেলে দিলেন কিছুটা জল |
এবার খুঁড়ে তুলে আনো শিকড় | বললেন গুরুদেব
দুই হাতে মাটি খুঁড়ে যেতে লাগলো গুরুপদ, শক্ত মাটি হাত দিয়ে খুঁড়তে খুঁড়তে, হাতের ছাল উঠে যেতে লাগলো, একবার পিছন ফিরে বললো , একটু জল হলে ভালো হতো, শিবাশিস আবার ও কিছুটা জল পাত্র থেকে ঢেলে দিলো | অনেক টা চেষ্টার পরে কিছুটা গাছের গোড়া হাতে পেলো সে, হাতের চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বের হচ্ছে |
থামলে কোনো গুরুপদ? টেনে আনো শিকড় | বললেন গুরুদেব
সাথে সাথেই গুরুপদ, ক্ষত বিক্ষত হাত টা দিয়েই তুলে আন্তে লাগলো মাটি, গর্তের মুখটা কিছুটা বড় হতেই, শিবাশিস পিছন থেকে বললো এই নাও
ঘুরে দেখলো, ছোট একটা ছুরি, গুরুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, নাও আবার শিকড় কাটো |
নাজানি কত শত বছরের পুরুনো গাছ, তার শিকড় কাটা কি মুখের কথা, ছোট্ট ছুরিটা দিয়ে ঘষতে ঘষতে মাটি আর ছুরি লাল রক্তে ভোরে উঠলো, অবশেষে হাতে উঠে এল কাঙ্খিত সেই শিকড় | আকাশ অনেকটা ফর্সা হয়েছে, সূর্য না উঠলেও, তাঁর উদয় হবার অগ্রিম আভাস দিয়ে শেষ রাতের তারাদের বিদায় জানাতে ব্যাস্ত |
গুরুদেব বললেন, হাতে তুলে নাও মাটি, সূর্য ওঠার আগেই আমাদের ফিরতে হবে, এখনো বাকি আছে আমাদের কিছু ক্রিয়া |
দ্রুতহাতে কিছুটা মাটি দুই হাতে ভোরে নিয়ে চললো গুরুপদ |
আশ্রম পেরিয়ে ওরা এসে ঢুকলো মাতৃ মন্দিরে ,
মায়ের পায়ের ফুল আর নানা দ্রব্য শালপাতা দিয়ে মুড়ে গুরুপদর হাতে দিয়ে বললেন, তোমাকে যে মন্ত্র আমি শিখিয়েছি, এই বস্তু তোমার কপালে ঠেকিয়ে সেই ব্যাক্তির মুখ মনে করলেই, সে তোমার বশীভূত, তারপর তুমি সেই ব্যাক্তি কে দিয়ে যে কাজ করতে চাও সেটা কল্পনা করলেই ব্যাক্তি সেইভাবেই কাজ করবে, তবে একজন ব্যাক্তির ওপর একবার এবং একটি মাত্র চিন্তায় আরোপ করতে পারবে তুমি | তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে গুরুপদ | শেষে আবারো একটা কথা তোমাকে মনে করিয়েদি, এই বিদ্যা ব্যবহার করে যদি কারো অনিষ্ট করো, তোমার জীবনে নেমে আসবে চরম অভিশাপ | মন্দিরের মা আর গুরুদেবকে প্রণাম করে সেদিনই বেলার ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরলো গুরুপদ | হাতের ব্যাণ্ডেজ দেখে সুলেখা কেঁদেই ফেললো, তুমি কোথায় ছিলে ঠিক করে বলতো! তোমাকে কি কেও ধরে রেখেছিলো ? ওরা কি তোমাকে মেরেছে? কি করে তোমার এমন অবস্থা হলো |
গুরুপদ বাবু হেসে উত্তর দিলেন, কে ধরে রাখবে আমাকে বলতো? কি ছেলে মানুষের মতো কথা বলছো | আমি আসলে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছি, পাথুরে রাস্তা ছিল, হাতটা ছোড়ে গেছে |
সন্ধে বেলা সুলেখা যখন রান্নাবান্না তে ব্যাস্ত, মেয়েরাও পড়াশোনা করছে, চুপিচুপি সেই শালপাতার মোড়কটা তুলে রামপ্রকাশ ঝুনঝুনওয়ালা আর মুখটা মনে করে মন্ত্রটা আওড়াতে লাগলেন, সব শেষে "ওম হুম ছিন্নমস্তায়ই নমঃ নামহ " বলে দুটি হাত টা কপালে ঠেকালো |
এরপরে টিভি দেখে সুলেখার সাথে নানা কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লো | আজ ঘুম থেকে উঠলো একদম সকাল ৬টা, প্রতিদিন, আশ্রমের নিয়ম টা অভ্ভাস হয়েছে তার | উঠেই, গুরু সেখান মন্ত্র উচ্চারণ করে, প্রাতঃকৃত্য সেরে, খবরের কাগজটা তে মন দিলো |
বেলা তখন ১০ টা হবে, মোবাইল ফোন টা বেজে উঠলো তার , রামপ্রকাশ ঝুনঝুনওয়ালা কল করেছেন, এখনই অফিসে দেখা করতে চান,
স্যার, আমার তো আজকে অনেক গুলো আছে, কাল গেলে হয় না? ইচ্ছা করেই, নিজের দাম বাড়াতে এটা বললো গুরুপদ |
"না না আজকেই দেখা করতে লাগবে, আপনাকে আমার খুব দরকার গুরুপদাবাবু, আজই আসেন আমার অফিস এ" | ফোনের ওদিক থেকে বলে রাকেশজি |
আড়মোড়া ভেঙে, ধীরে সুস্থে, ঝুনঝুনওয়ালার অফিস এ গেলো গুরুপদ |
ব্যাপার খুবই জটিল, ইনকাম ট্যাক্স থেকে রেইড করবে, তাই কিছু টাকা এমন তাঁর আছে যা এখনই তিনি গুরুপদদের কোম্পানির নানা পলিসিতে রাখতে চান, আর শুধু গুরুপদবাবুকেই তিনি বিশ্বাস করেন, ওনার কাছেই সব পলিসি করবেন | মনে মনে একটু হাসলো গুরুপদ,
মুখে বললো "আচ্ছা আচ্ছা আপনার বিপদে আমি তো সবসময় পাশে আছি স্যার", তারপরেই ফর্ম বের করে ফিলআপ করতে লাগলো , আপনার এমাউন্টটা কত লিখবো স্যার? এখন ১ ক্রোড়ে লিখে রাখুন, সব মিটে গেলে আমি আরো কিছু ইনভেস্টমেন্ট করবো,
"১ কোটিতে কটা শুন্য হয়?" কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো গুরুপদর, হাতের আঙ্গুল গুনে গুনে ফর্ম এ বসলো সে, চেক টা হাতে নিয়ে, মুখে সেই পেশাদারি হাসিটা নিয়ে অফিস এ এলো গুরুপদ |
রোহিত আগরওয়াল মিটিং এ ছিলেন, তাই বাইরে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলো , পাঁচু এসে বললো কি স্যার, একদম বেপাত্তা হয়ে গেছিলেন তো, সেদিন আমি গেলাম আপনার বাড়ি, বৌদি কিছু বলেনি,
হেসে গুরুপদবাবু জবাব দিলো , বলেছে তো|
তোমার সাহেবের কত দেরি গো?
আর বলবেন না, সেলস নেই তো, খুব মেজাজ গরম সাহেবের, এমন সময়, বেল বাজলো, রোহিত আগরওয়ালার,
পাঁচু চট করে তার রুম এ ঢুকেই বেরিয়ে এসে বললো, সাহেব ডাকছেন আপনাকে |
যতই ভালো নিউস থাকুক আজ মুখে কিছু বুঝতে না দিয়ে ঘরে ঢুকে গুরুপদবাবু বললো, স্যার কেমন আছেন, অনেক দিন পরে এলাম |
এসব বাজে কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, আপনাকে তো আগেই বলেছি, যদি আপনার সেলস হয়, তবেই আসবেন |
হা স্যার, টা সামান্য সেলস হয়েছে,
ও টা কত শুনি? ১০ হাজার? তির্যক ভাবে হেসে বলে রোহিত
না স্যার, সামান্য বেশি বলে চেক আর ফর্ম টা বের করে রোহিত আর টেবিল এ রাখলো গুরুপদ
কোনো কথা বের হচ্ছিলো না রোহিত আগারওয়ালের |
মার্ভেলস গুরুপদবাবু, কি করে করলেন এটা? ঝুনঝুনওয়ালা তো কিছুতেই আমাদের এখানে ইনভেস্ট করবেন না বলেছিলেন, আমি নিজে সেদিন ফোন করলাম, বললেন এখন না |
এই জন্যই তো আমার নাম গুরুপদ দত্ত স্যার, আমি এটা একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট এ জমা করে আসছি,
আরো ২-৩ দিন কেটে গাছে, এবার প্রখ্যাত ব্যবসাদার সুরেন রায় এর কথাটা মনে পড়লো গুরুপদর , কয়েকমাস আগেই কলকাতার কোনো সভায় ওনাকে আন্তর্জাতিক বাঙালি হিসাবে ব্যাবসায়ী হিসাবে পুরস্কার দেওয়া হলো | পুরোনো খবরের কাগজ ঘেটে, ওনার একটা ছবি বের করে, মনে মনে গুরুর দেওয়া মন্ত্র আর শালপাতার মোড়কটা হাতে নিয়ে শুরু করলো ক্রিয়া |
পরের দিন অফিস থেকে স্বয়ং রোহিত আগারওয়াল ফোন করেছেন,
হা স্যার গুড মর্নিং বললো গুরুপদ
ওই দিক থেকে শোনা গেলো, গুরুপদ বাবু আজকেই একবার অফিস এ আসুন, খুব দরকার |
স্নান খাওয়া করে অফিস এ পৌঁছে পাঁচুকে বললো , সাহেব আছেন নাকি রুম এ?
আছেন মানে আপনাকে এলেই পাঠিয়ে দিতে বলেছেন |
মনে মনে কিছুটা আন্দাজ করলেও মুখে সেটা বুঝতে না দিয়ে, আগারওয়াল সাহেবের ঘরে ঢুকে গুরুপদ বললো , গুড মর্নিং স্যার, বলুন |
অরে আসুন আসুন, দত্ত বাবু, ঝুনঝুনওয়ালা ফোন করেছেন, ওনার ফ্রেন্ড আছেন, সুরেন রায়, তিনি নাকি আপনার সাথে দেখা করতে চান, আজই অফিসে এ যেতে বলেছেন, কিসব ইনভেস্টমেন্ট আর ব্যাপারে, ঝুনঝুনওয়ালা নিজে আপনার নাম রেকমেন্ড করেছেন | প্লিজ আজ ই একবার দেখা করে আসুন |
আচ্ছা ঠিক আছে
আর শুনুন না, বাস ট্যাক্সি করে কষ্ট করতে হবে না, আমার গাড়ি টা নিয়ে যান আপনি, ড্রাইভারকে আমি বলে দিচ্ছি ঠিকানা,
আচ্ছা স্যার, বলে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো গুরুপদ |
এখানেও সেই একই ঘটনা ঘটলো, সুরেন বাবু নাকি দীর্ঘদিন ধরেই, একজন বিস্বস্ত লোক খুঁজছিলেন, কিছু ইনভেস্ট করবেন কোলকাতাতে, তেমন কেও মনে আসছিলো না, ঝুনঝুনওয়ালা নাকি নিজে থেকে রেকমেন্ড করেছেন ওনাকে, এটা সেটা নিয়ে কথা বলার পর তিনিও বললেন, বেশি না ১০ কোটি মতো ইনভেস্টমেন্ট করবো, আমাকে ভালো কিছু প্ল্যান্স সাজেস্ট করুন |
খুব পেশাদারি ভঙ্গিতে, ওনার সাথে কথা বললো গুরুপদ আর বলাবাহুল্য প্ল্যান টা নিজে রাজিও হয়ে গেলেন উনি |
ভাগ্যের চাকাটা ঘুরে গেল গুরুপদর | কোম্পানির মালিক রাকেশ বাল্মীকি নিজে থেকে ওকে কংগ্রাচুলেতে করলেন, আর চাকরিতে আবার জয়েনও করে যেতে বললেন,
এবার গুরুপদ ভাবছিলো, তার অনেক দিনের অপমান আর উপেক্ষার সে মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে | সেদিন রাত্রে সে বসলো তার সম্মেহনের যন্ত্রম নিয়ে, আজ তার টার্গেট, রাকেশ বাল্মীকি | গুরুর আদেশ তার এখনো মনে আছে, ৩ বার সে এই শক্তি কে ব্যবহার করতে পারবে, ইতিমধ্যেই দুইবার ব্যবহার করে ফেলেছে সে এটাই তার শেষ বারের মতো ব্যবহার | তিনি মাথায় শালপাতার মোড়কটি ঠেকিয়ে রেখে রাকেশজির ওপর নিজের চিন্তা কে আরোপ করতে লাগলো , নিজের মনে ভাবতে লাগলেন, রোহিত অগ্রবাল এর চেয়ার এ গুরুপদ দত্ত বসেছে, আর সেটা রাকেশজি নিজে থেকেই এপয়েন্টমেন্ট করে দিচ্ছেন |
বলা বাহুল্য হলোও তাই, মাত্র ১ সপ্তাহের নোটিশ এ রোহিত অগ্রবাল এর বদলে গুরুপদ হয়ে বসলো, জোনাল হেড | দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো সংসার, মেয়েরা বোরো স্কুল এ ভর্তি হলো, সুলেখার নামে একটা বোরো বাড়ি কিনলো , দু খানা গাড়ি, এক কথায় ভাগ্য লক্ষ্মীর বরপুত্র বলে সবাই ডাকতে লাগলো ওকে | কিন্তু সব গল্প রূপকথার মতো সুখের হয়না | এক্ষেত্রেও তাই হলো |
একদিন রাত্রে গুরুপদবাবু স্বপ্ন পেলেন তাঁর গুরুদেবের, ভীষণ ঘৃণা ভরে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে,
"এই শক্তি আরোপ করে কারো অধিকার কেড়ে নিলে তার জন্য চরম অভিশাপ নেমে আসবে তার ওপর" | কথাটা কি তুমি ভুলে গেলে গুরুপদ বললেন গুরুদেব ?
আর এই ক্ষেত্রে এককথায় জোর করে নিজের সম্মোহন শক্তির প্রয়োগে যে রোহিত অগ্রবালের পদ কেড়ে নিয়েছিলো তা গুরুপদ নিজেও ভালো করে জানতো |
আমাকে ক্ষমা করে দিন গুরুদেব, লোভ আর প্রতিহিংসার বসে করে ফেলেছি,
এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে, বলে গুরুদেব মিলিয়ে গেলেন |
ঘুমটা ভেঙে গেল গুরুপদর |
২ মাস পরে, গুরুপদ বুঝতে পারলো কতবড় ভুল সে করেছে, গত কয়েক বছরে রোহিত অগ্রবাল কোম্পানির একাধিক ফান্ড এ নয়ছয় করেছে, নিজের নাম বহু টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছে | কিন্তু এমন সুকৌশলে সেটা তিনি করেছেন, কোম্পানির কেও সেটা বোঝেনি | তারপর গুরুপদ শেষ কয়েক মাসে এত কোটি কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে এনেছে যে, আরো অনেক বড় বড় ইনভেস্টের ওদের সাথে জুড়ে গেছে, ফল স্বরূপ, এত বেশি টাকার স্ক্যাম হয়ে গেছে যা ওপর থেকে বোঝায় যাচ্ছে না | রোহিত তার পদ ছাড়বার আগে, কন্ট্রাক্ট পেপারে গুরুপদ সিগনেচার করে নিয়েছে, যে কোম্পানির সব ফান্ড ঠিক আছে এবং সে নিজের দায়িত্বে সব বুঝে নিলো , তাই বর্তমান কর্মকর্তা হিসাবে এই বিপুল গরমিলের দায়ভার ওর একার ওপর |
মাথায় হাত পড়লো | কথা থেকে পাবে সে এত টাকা |
খবর পাওয়া গেলো রোহিত ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে গেছে | মানে আর কোনো উপায় নেই, হয় টাকা চুরির দায়ভার তাকে নিতে হবে নাহলে আত্মহত্যা করতে হবে |
সেদিন অফিস থেকে অনেক রাত্রিবেলা ফিরলো গুরুপদ, সম্পূর্ণ বিধস্ত, সুলেখা বার বার জানতে চাইলো কি হয়েছে তার?
গুরুপদ কোনো ভাবে এড়িয়ে গিয়ে নিজের স্টাডি তে এসে বসে থাকলো বেশ কিছু সময় | ওপরে পাখাটা বন-বন করে ঘুরছে, এক দৃষ্টি তাকিয়ে ছিলো সে |
সুলেখা অনেক্ষন কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে স্বামীকে ডাকতে স্টাডিতেই আসছিলো , হঠাৎ খুব জোরে কিছু পড়ে যাবার শব্দ পেতেই ছুটে এলো সে | স্টাডির দরজাটা ধাক্কা দিতে লাগলো, কিগো, কি পড়ে গেল, দরজা টা খোলো,
পাখার থেকে তখন গুরুপদর ঝুলন্ত শরীরের পা দুটো ছট-ফট করছিলো, জিভ টা বেরিয়ে আসছিলো, পায়ের নিচে ঠেলে ফেলে দেওয়া টুলটা হয়তো শেষবারের মতো আরো একবার ছুঁতে চাইবার, বিফল চেষ্টা করতে করতে থেমে গেল শরীরটা,
ধুম ধুম করে শব্দ হচ্ছে দরজায়, সুলেখা কান্না ভরা আকুতিতে ডাকছে, খোলো দরজাটা, মেয়ে দুটো বাবা বাবা করে ডেকেই যাচ্ছে |
দেবার্ঘ্য মুখার্জী
ভারত।
ইমেইল: friend.welcome.2008@gmail.com